কুরবানি দে
ওয়াহিদ জামান



আত্নত্যাগের দীক্ষা নিয়ে

এলো যে আযহা,

কুরবানি দে ভুলে গিয়ে

সকল অনীহা।



কুরবানিতো ইব্রাহিমের

পরীক্ষার ফসল,

কুরবানি দে হতে চাইলে

জীবনে সফল।



কুরবানিতে আছেরে ভাই

খোদায়ী সন্তোষ,

কুরবানি দে বিধান মতো

করিস নারে দোষ।

বর্ষা
ওয়াহিদ জামান

বর্ষা, বর্ষা, বর্ষা,
আকাশ নয়তো ফর্সা
ঘন কালো মেঘে আকাশ,
এলোমেলো বয় ঠান্ডা বাতাস
বিদ্যুৎ চমক আর বজ্রের হুংকার,
মানব মনে হয় ভীতির সঞ্চার

বর্ষা, বর্ষা, বর্ষা,
নেমে পড়ে হরষা
খাল-বিল, মাঠ-ঘাটে পানির মেলা,
সূর্য যেন আজ করছে হেলা
রাস্তা ঘাট পিচ্ছিল কর্দমাক্ত,
সে বলছেআমি শক্তের ভক্ত

বর্ষা, বর্ষা, বর্ষা,
কৃষক মনের ভরসা
সারাদিন সবে করছে রোপন,
আউস, বোরো আর নতুন আমন
দুচোখে দেখি সবুজপাতা,
পেয়েছে ফিরে সজীবতা

ষোলই ডিসেম্বর 
ওয়াহিদ জামান
 
মুক্তিসেনা        পণ ভাঙ্গে না
আনবে বিজয় তারা,
ভোর বিহনে         রণাঙ্গনে
রুখবে তাদের কারা?

আসছে দামাল    করছে সামাল
দেখবি তোরা আয়,
টগবগিয়ে      ঝনঝনিয়ে
সামনে তারা যায়।

জাগছে প্রবীণ     আসছে নবীন
হাঁকিয়ে তাদের রথ,
পাক সেনারা       আর পাবিনা
পালিয়ে যাবার পথ।

এই শপথে       মরবে পথে
ফিরবে নাতো ঘরে,
অবশেষে      বিজয় আসে
ষোলই ডিসেম্বরে।
টয়লেট নামা
ওয়াহিদ জামান


আগে দু’য়া পড়তে হবে,
তারপরেতে বাম পা দিবে।
করো না ভাই গাফিলতি,
খালি করো ভরা বালতি।

বেশি বেশি ঢাল পানি,
ভালো বংশের? তবেই মানি।
বের হতে হয় ডান পা দিয়ে,
দু’য়া পড় বাইরে গিয়ে।
মাহফুজ আখন্দ
ওয়াহিদ জামান
(উৎসর্গ- ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ স্যারকে)

 
দুহাজার আট সাল রঙ্গিন বিকেল
বিকল্প রাকসুতে সোনালী নিকেল

শিল্পীর সমাবেশে গাইলেন তিনি
সেদিনই তাঁকে আমি নতুন চিনি

সাজুগুজু আঁকিবুকি রংতুলি রঙ্গন
গড়েছেন সযতনে চারুকারু অঙ্গন

ছন্দের জাদুকর অনুপম কবি
প্রবন্ধে এঁকে যান বাস্তব ছবি

ইতিহাস লিখনে গবেষক যিনি
রকমারী গান সুরে গীতিকার তিনি

ফিচার কলাম লেখা নয় মোটে অল্প
লিখেছেন মজাদার শিশুতোষ গল্প

তাঁর মন খুঁজে পায় সাহিত্যে আনন্দ
সকলের প্রিয় তিনি মাহফুজ আখন্দ।
ঈদ আসেতো সবার তরে
ওয়াহিদ জামান


রমজান শেষে ঈদুল ফিতর,
আনন্দ ধারা মনের ভিতর।
নতুন জামা, নতুন জুতা,
মনে আছে কি দুঃখীর কথা?
 

দালান থেকে, বস্তি হতে,
যায় দেখ সব ঈদ জামাতে।
ধনী-গরীব এক কাতারে,
নাই ভেদাভেদ আমীর ফকিরে।


দুঃখীও যেন হাসতে পারে,
ঈদ আসেতো সবার তরে।

ঢাকার ঈদ
ওয়াহিদ জামান

ঈদের ঢাকা, ফাকা ফাকা
একলা শুয়ে আছি,
কল্পনাতে জল্পনাতে
গ্রামে চলে গ্যাছি

সকাল হতে ঈদগাহেতে
থাকতো অনেক কাজ,
ফুল টানানো, রং লাগানো
হরেক রকম সাজ

পুকুর জুড়ে ভেলায় চড়ে
গোসল করতো সবে,
মুরুব্বিরা বলতো এসে
মাঠে যাবে কবে?

নামাজ শেষে বাবা যেতেন
দাদার কবর পাশে,
আমি থাকতাম তারই কাছে
মুচকি মুচকি হেসে

দু°হাত তুলে মোনাজাতে
কাঁদতেন বাবা যখন,
বুঝতাম নাতো কেন তিনি
এমন করেন তখন

তারপর হতো বাড়ী বাড়ী
ঘুরে ঘুরে খাওয়া,
বিকাল হলেই মায়ের সাথে
নানার বাড়ী যাওয়া

এখনতো আর সেই আনন্দ
পাইনা খুজে আমি,
আমার অতীত দাও ফিরিয়ে
ওহে অন্তর্যামী

তবুও গ্রেফতার


পরেছে শাড়ি       সেজেছে গাড়ি
নেই অনুমতি
সরকারী বীর      করেছে ভীড়
বাড়ায় দূর্গতি।

নেত্রী সেনা      তুলেছে ফণা
বিষাক্ত এক সাপ,
করবে দংশন       মরবে জনগণ
এটাই কি সংলাপ?

এটা গণতন্ত্র       নাকি স্বৈরতন্ত্র
জানে না মানুষ,
নাশকতার গন্ধ       করছে অফিস বন্ধ
নেতারা বেহুশ।

আইনের ফাঁদে        গণতন্ত্র কাঁদে
অনড় সংবিধান,
মানুষ মিছে       দেশ যে পিছে
নেত্রীই প্রধান।

পতাকা সাথে       লাঠি হাতে
নেমেছে সরকার,
বিরোধী বলে       নিরস্ত্র চলে
তবুও গ্রেফতার।
ফিলিস্তিনি  শিশু
ওয়াহিদ জামান

একটাই আমার ইস্যু
ফিলিস্তিনি শিশু
মরবে কেন ভাই?

অপরাধী কেউ
করছে যে ঘেউ ঘেউ
এর কি বিচার নাই?

মুসলিম বলে হেই
অপরাধতো নেই
জন্ম এখানেই,

মোড়ল মোড়ল ভাব
যেন এক কালসাপ
মারছে সকলকেই।

মুসলিম নেতা যারা
চুপ করে কেন তোরা
নাই কি করার কিছু?

ঈমান যদি থাকে
বিদায় বলো মাকে
ফিরবে না আর পিছু।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সন্ধানে
ওয়াহিদ জামান

হেমন্তের সন্ধ্যা। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। তেমন কোন কাজ নেই। ভাবলাম, রাশেদ ভাইয়ের রুম থেকে ঘুরে আসি। যেই ভাবা সেই কাজ। পথ ১০ মিনিটের। কল্পনায় স্বপ্ন বুনতে বুনতে পৌঁছে গেলাম। ভিতরের হই-হুল্লোড়ের শব্দ বাইরে থেকেই শোনা যাচ্ছে। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই উল্লসিত রাশেদ ভাই জানালেন বিশাল আয়োজনের বিরাট পরিকল্পনা। শেরপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা ও খুলনা ভ্রমণের বিশাল সিডিউল। ভ্রমণ! আমার আনন্দ দেখে কে? সেই থেকে মন জুড়ে ভ্রমণ, ভ্রমণ, ভ্রমণ আর ভ্রমণ। চোখে যেন ঘুম নেই। প্রতিদিনই আপডেট হচ্ছে সিডিউল। চলছে তথ্য সংগ্রহ। বাজেট ৮ দিনের। সময় ও স্থান বিবেচনায় এবারের মত বাদ পড়লো খুলনা। আগামী বছর হবে খুলনা ভ্রমণ। বলছি ‘গ্রুপ ভ্রমণ ২০১১’ এর প্রারম্ভের কথা।
২০১২ সাল কেটেছে অনেক ব্যস্ততায়। ডিপার্টমেন্টের পিকনিক, কুমিল্লা বার্ড-এ ৬ দিনের প্রশিক্ষণ সফর, দেলোয়ারের আমন্ত্রণে নাটোর ভ্রমণ, সম্পার বিয়ে উপলক্ষে উত্তরাঞ্চলে ৪ দিনসহ ছোট-বড় বেশ কয়েকটি ভ্রমণ করতে হয়েছে পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই। যে কারণে এবছরেও খুলনা ভ্রমণ সম্ভব হয়নি।

জানুয়ারি, ২০১৩। এ মাসের শেষভাগে শীতকালীন অবকাশ। রাশেদ ভাইয়ের রুমে চলছে গ্রুপ মিটিং। বিষয়- গ্রুপ ভ্রমণ ২০১৩। সিদ্ধান্ত গৃহিত। বাজেট ৭ দিনের। গন্তব্য কাংখিত খুলনা বিভাগ। সেই থেকে শুরু হলো প্রস্তুতি। তৈরী করলাম সাত দিনের সিডিউল। সবই প্রস্তুত কিন্তু টাকা নেই। অবশেষে ঋণ।

আমাদের এবারের ভ্রমণের মোট সদস্য ৬ জন। মোমিন, সৈকত, রাশেদ ভাই, ওলি, হাসান এবং আমি। আরও একজনের থাকার কথা ছিল। কিন্তু তার হাত সবার মত দু’টা নয়, তিনটা। ডান হাত, বাম হাত এবং অজুহাত। তার এই তৃতীয় হাতের গুণেই যেতে পারেনি আমাদের সাথে। অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম আমরা। তাই এমন করেই লিখতে হল। আর সে হল আমাদের একান্ত কাছের বন্ধু ও ভ্রমণের নিয়মিত সঙ্গী আলিম। একদিন আগে কেটে পড়ে সে। যাক সে কথা। রাত্রে হঠাৎ মোনালিসার ফোন। ভাইয়া, আমি লালনের মাজারে আপনাদের সাথে দেখা করবো। সম্মতি জানালাম। এভাবেই অপেক্ষার পালা শেষ।

২১ জানুয়ারী ভোর ৫ টা ২০ মিনিট। দাঁড়িয়ে আছি বিনোদপুর বাসস্ট্যান্ডে। গাড়ি আসবে ৫ টা ৩০ এ। কিন্তু কাংখিত সে গাড়ি আর আসে না। অবশেষে ৬ টার দিকে বরিশাল গামী এক বাসে চড়ে রওনা দেই কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে। সাড়ে ৮ টার দিকে পৌঁছে যাই মজমপুর গেট। হালকা নাস্তা শেষে ইজিবাইক যোগে লালন শাহ মাজারে। লালন (জন্ম ১৭৭৪- মৃত্যু অক্টোবর ১৭, ১৮৯০) বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালী যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, দার্শনিক, অসংখ্য অসাধারণ গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে বাউল গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার গানের মাধ্যমেই ঊনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। কুষ্টিয়া শহরের ছেউড়িয়ায় তার মাজার ও আখড়ায় কাটালাম প্রায় ৪৫ মিনিট। এসময় এক লালন ভক্তের সাথে আলাপচারিতা এবং ফটোসেশন শেষে রওনা দিলাম রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীর উদ্দেশ্যে।


ছোট বেলায় পড়েছিলাম জসিম উদ্দীনের লেখা ‘গড়াই নদীর তীরে’ কবিতাটি। সেই গড়াই নদীর যৌবন আর নেই। দুই পাশে বালুময় মরুভূমি আর মাঝে খাল সদৃশ ছোট এক নদী। অনেক কষ্টে সেই নদী পার হই আমরা। ভাঙ্গা রাস্তায় চলে ইজিবাইক জার্নি। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ। পৌঁছে যাই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এ অঞ্চলের জমিদারি পান। পরবর্তিতে ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে জমিদার হয়ে আসেন। এখানে তিনি ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী পরিচালনা করেন। এ সময় এখানে বসেই তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, গীতাঞ্জলি ইত্যাদি।

আমরা পৌছানের কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যায় লালন কন্যা মোনালিসা। সাথে বড় দুইটা ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে অনেক গুলো বক্স। আর বক্স ভর্তি হরেক রকম পিঠা। পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে বসে খাওয়া হয় পিঠা আর দধি। কিন্তু এত খাবার! শেষ করতে পারিনি আমরা। তারপর ঘুরাফেরা আর ফটোসেশন। খালাত ভাইয়ের হোন্ডায় বিদায় নেয় মোনালিসা। আমরাও ইজিবাইক যোগে কুষ্টিয়া ফিরে রওনা দেই মেহেরপুরের উদ্দেশ্যে।


বাসে সিট পাইনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্পে গল্পে চলছে তো চলছে। খারাপ লাগেনি মোটেও। মেহেরপুরে পৌঁছেই নামাজ। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে বাসযোগে মুজিবনগর পৌঁছে যাই সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের জন্মলগ্নের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার অন্য মন্ত্রীরা এই পুণ্যভূমিতে শপথ গ্রহণ করেন। মুজিবনগর সরকার গঠনের আগমুহূর্তেও বৈদ্যনাথতলা ছিল এক অপরিচিত গ্রাম। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মেহেরপুরের এ গ্রামটির নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। এখন দেশের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান এটি। অনেক স্থাপনাও তৈরি হয়েছে। আরো কিছুর কাজ চলছে। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি ও হালকা আলোয় ফটোসেশন শেষে ইজিবাইক যোগে রওনা দেই আমঝুপি নীলকুঠি। কথিত আছে, এখানেই মীর জাফরের সাথে ইংরেজদের গোপন চুক্তি হয়েছিল। যার ফলশ্রুতি পলাশী ট্রাজেডি, দু’শো বছরের গোলামী। এখানে কাটাই কিছুক্ষণ। তারপর রাত ৯টার দিকে পৌঁছে যাই হাসানের বাড়িতে। ভারী খাওয়া দাওয়া এবং কফি পেয়ানো শেষে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে চাচার বাসা। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে চলে ঘুমের অভিনয়। এভাবেই রাত পার। সকালে শুরু হল আপেল কুল দিয়ে। তারপর ভারি খাবার দিয়ে শেষ। হাসানের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে যশোরের উদ্দেশ্যে আমরা।

গাড়ী ওয়ালাদের চরম প্রতারণার স্বীকার, বার বার গাড়ী পাল্টিয়ে ৩টার দিকে যশোরের ধর্মতলা। আপন মোড় হয়ে শারিফাদের বাসা। হালকা ফ্রেসনেস এবং নামাজ শেষে খাবার টেবিলে আমরা। শুরু হলো নির্যাতন, একের পর এক আইটেম। আসছে তো আসছে। কত আর খাওয়া যায়, পেট তো আগের মতই আছে। ২০ আইটেমের খাবার, ছবি তুলেই শেষ করতে হলো। তারপর মাগরিব নামাজ শেষে শারিফাকে নিয়ে বের হলাম আমরা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সিনেমা হল যশোরের মনিহার। এর সামনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাস যোগে বাঘারপাড়া। শরিফাকে ওর স্বামীর কাছে হস্তান্তর করে আমরা চলে গেলাম ওলিদের বাড়িতে। সেখানেও একই অবস্থা। খাবারের অত্যাচার। পিঠা পায়েশ থেকে শুরু করে আরো কত কিছু। রাতের ঘুম শেষে সকালে বেরিয়ে পড়ি ফসলের মাঠের দিকে। লুঙ্গি পরে গ্রাম্য বেশে প্রায় ১ ঘন্টা । বাড়ি ফিরে খেজুরের রস আর পিঠা। হালকা একটা গোসল, তারপর খাওয়া দাওয়া সেরে নড়াইলের উদ্দেশ্যে রওনা।


আমাদের ভ্রমণের সবচেয়ে খারাপ রাস্তা এটি। সেই সাথে বাসটাও। সাড়ে ১২ টার দিকে পৌঁছে যাই নড়াইল। প্রথমে স্বপ্নবীথি পিকনিক স্পট এবং হালকা ফটোসেশন। তারপর চলে যাই নিরিবিলি পিকনিক স্পট। নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদে গিয়ে দেখা হয় ছোট মামা হাফেজ আব্দুস সাত্তার এর সাথে। তারা মাদরাসার শিক্ষা সফরে এসেছেন। তারপর ভিতরে প্রবেশ, রোপওয়েতে ওঠা, ফটোসেশন, ছোট বেলার সেই হালকা পাপড় খাওয়া। বাইরে এসে পা ভ্যান যোগে বাসষ্ট্যান্ড। সরাসরি খুলনাগামী বাসে উঠে পড়ি। পথিমধ্যে বিদায় নেয় ওলী। অসম্ভব খারাপ লাগছিল তখন। সন্ধ্যার একটু পরেই আমরা পৌঁছে যাই খুলনার দৌলতপুর। সেখানে অপেক্ষায় ছিল লিটন। বি.এল. কলেজের ছাত্র। আমার এলাকার ছোট ভাই। তার সাথে চলে যাই পাবলা তিন দোকানের মোড়ে অবস্থিত আ্যপটেক হাউজ ছাত্রাবাসে। ব্যাগ গুলো রেখে রওনা হই শহর ঘুরতে। খুলনা শহর। বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত তৃতীয় বৃহত্তম শহর। বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেষে রূপসা ও ভৈরব নদীর মোহনায় শিল্পনগরী খুলনার অবস্থান। একসময় শিল্পশহর হিসাবে বিখ্যাত হলেও বর্তমানে এখানকার বেশিরভাগ শিল্পই রুগ্ন। পূর্বে খুলনাতে দেশের একমাত্র নিউজপ্রিন্ট ও হার্ডবোর্ড মিল ছিল। যা এখন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। খুলনার বেশির ভাগ পাটকলগুলোও একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে খুলনার উল্লেখযোগ্য শিল্প হল বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে ওঠা রপ্তানীযোগ্য মাছ শিল্প। বিশেষ করে হোয়াইট গোল্ড খ্যাত চিংড়ি। খুলনাকে এজন্য রূপালি শহরও বলা হয়। রাস্তাঘাট বেশ প্রশস্ত। স্থাপনা গুলোয়ও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। নিউ মার্কেট, বাইতুন নুর মসজিদ কমপ্লেক্স, এরশাদ শিকদারের স্মৃতি বিজোড়িত স্বর্ণ কমল ও খুলনা নেছারিয়া কামিল মাদরাসা দর্শন শেষে ঘুমের উদ্দেশ্যে অ্যাপটেক হাউজ।


২৪ জানুয়ারী বাদ ফজর। ইজিবাইক যোগে সোনাডাংগা বাস টার্মিনাল। হোটেলে নাস্তা শেষে জানতে পারলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে সকল বাস রিজার্ভ করা হয়েছে। কোনো বাসই যাবে না কোন গন্তব্যে। পরামর্শ পেলাম রুপসা ফেরী ঘাটে যাওয়ার। অগত্যা রুপসা ফেরীঘাট যেয়ে বাস যোগে রওনা দেই মংলার উদ্দেশ্যে। সকাল ৯ টার দিকে পৌঁছে যাই দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র
বন্দর মংলা। হালকা নাস্তা সেরে চলে যাই পশুর নদীর ঘাটে। সেখানে পড়ে যাই ট্রলার সিন্ডিকেটের খপপরে। ট্রলার ভাড়ার উচ্চ মূল্য, কামাবেন না কেউ। অগত্যা বেশি টাকা দিয়েই ভাড়া করলাম একটি ট্রলার। উঠে পড়লাম সবাই। পশুর নদীর উপর দিয়ে বট বট শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্রলার। কিছুক্ষণ পরেই সুন্দরবন এরিয়া। কূল ঘেঁষে চলছে আমাদের ট্রলার। মহান প্রভুর অকৃত্রিম সৃষ্টি। কতই না সুন্দর সে দৃশ্য! কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে বুক। নত হয় মস্তক। প্রায় ৪৫ মিনিট চলার পর আমরা পৌঁছে যাই কাংখিত সেই সুন্দরবন। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখন্ড বনভূমি। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। বনভূমিটি, স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। বাংলায় ‘সুন্দরবন’-এর আক্ষরিক অর্থ "সুন্দর জঙ্গল" বা "সুন্দর বনভূমি"। সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে, যা এখানকার প্রধান বৃক্ষ।

আমরা এখন অবস্থান করছি করমজলে। পর্যটকদের জন্য নিরাপদ বলয়ে গড়ে তোলা সুন্দরবনের একাংশ। এখানে সাপ ছাড়া অন্য কোন হিংস্র প্রাণীর ভয় নেই। কাটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে বিরাট এক অঞ্চল। নেমে পড়ি সুন্দরবনের ভিতর। গাছে চড়া, হই-হুল্লোড় আর ফটোসেশনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি কাঠের তৈরী ব্রীজ সদৃশ রাস্তা দিয়ে। সুন্দরবনের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে বিমোহিত সবাই। কখন যে দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। ফিরে এলাম ট্রলারে, তারপর মংলা সমুদ্র বন্দর। কোন বাস না পাওয়ায় মাইক্রোবাসে করে রওনা দেই চন্দ্র মহলের উদ্দেশ্যে। মাইক্রো থেকে নেমে ভাঙ্গা-চোরা ইটের রাস্তা বেয়ে এগিয়ে চলে আমাদের পা ভ্যান। অবশেষে চন্দ্রমহল। অনেক নতুনত্ব আছে এখানে। পানির নিচ দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে চন্দ্র মহলের মূল স্থাপনা, খুলনা-বাগেরহাট রেল লাইনের নকশা, ছোট ষাট গম্বুজ মসজিদ, ফেলানী মনুমেন্ট, পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের দূরত্ব এবং দিক, অসংখ্য ছোট ছোট পুকুর। মোট মিলে দেখার মতো একটি জায়গা। চন্দ্র মহলের বাইরে আছে চির কুমার আনন্দ নিকেতন। ছবি উঠালাম সেখানে।

চন্দ্র মহল থেকে মেশিন ভ্যান যোগে রূপসা সেতু। বাংলাদেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন সড়ক সেতু এটি। পায়ে হেঁটে পার হলাম আমরা। ঘুরানো সিঁড়ি বেয়ে সেতুর নিচে নামলাম। তারপর ইজিবাইকে চড়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে অপেক্ষায় ছিল ভাগ্নে মাসুম বিল্লাহ মন্টু। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার ফুফাতো বোনের ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয় পুরোটাই ঘুরে ঘুরে দেখালো সে। তারপর আবার ইজিবাইক। পৌঁছলাম খুলনার প্রথম ডিজিটাল মার্কেট মিনা বাজারে। চলল সামান্য কেনা কাটা। পায়ে হেটে ডাকবাংলা, খুলনা সপিং কমপ্লেক্স, সৈকতের মোবাইলের ব্যাটারী এবং মোমিনের মোবাইলের হেডফোন ক্রয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার ইজিবাইকে করে দৌলতপুরের অ্যাপটেক হাউজ। রাত্রি যাপন।

২৫ জানুয়ারী বাদ ফজর বেবী ট্যাক্সি যোগে রুপসা ফেরী ঘাট। নাস্তা শেষে বাসে চড়ে বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা। বাস আমাদের পৌঁছে দেয় খানজাহান আলীর মাজার। মাজারের সামনে বিশাল দিঘি, শান বাঁধানো ঘাট, দিঘির পানিতে ভেসে আছে লাল রঙের পদ্ম। অত্যন্ত সুন্দর সে দৃশ্য। মাজারে রয়েছে ভক্ত নামীয় দালালদের উৎপাত। এখানকার পাট শেষ করে রওনা দেই স্যার পিসি রায়ের স্মৃতি বিজোড়িত বাগেরহাট পিসি কলেজ। কলেজের পেছনে রয়েছে সুরম্য রামকৃষ্ণ মন্দির। তারপর ইজিবাইক যোগে ষাট গম্বুজ মসজিদ।


ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি। মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। তাই এটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা কোন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিলো সে সম্বন্ধে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে এটি যে খানজাহান রহ. নির্মাণ করেছিলেন সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ থাকে না। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮.৫ ফুট পুরু। মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে ১১টি বিরাট আকারের খিলানযুক্ত দরজা আছে। মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর চেয়ে বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে ৭টি করে দরজা। মসজিদের ৪ কোণে ৪টি মিনার আছে। এগুলোর নকশা গোলাকার এবং এরা উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। মসজিদের ভেতরে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলার আছে। এগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে ৬ সারিতে অবস্থিত এবং প্রত্যেক সারিতে ১০টি করে স্তম্ভ আছে। মসজিদটির নাম ষাট গম্বুজ (৬০ গম্বুজ) মসজিদ হলেও এখানে গম্বুজ মোটেও ৬০টি নয়। গম্বুজ ১১টি সারিতে মোট ৭৭টি। ফটোসেশন শেষে অজু করি। এবার জুম্মার নামাজের উদ্দেশ্যে ষাট গম্বুজের অভ্যন্তরে। দৃষ্টি নন্দন এক স্থাপত্য শৈলী। অবাক করে দেয় সবাইকে। মসজিদকে ঘিরে বিশাল এক এরিয়া জুড়ে নানান রকম ফুলের বাগান। পশ্চিমে আছে এক বিরাট দিঘি। সেখানেও ফুটে আছে অনন্য সুন্দর পদ্ম।

ছোট এক হোটেলে খাবার খেয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে বাস ধরি। বাস আমাদের নামিয়ে দেয় সোনাডাংগা। তারপর ইজিবাইকে চড়ে খুলনা সার্কিট হাউজ, জেলা স্টেডিয়াম, কোর্ট ভবন ও নগর ভবন। ইজিবাইক পরিবর্তন করে খালিশপুর শিল্প নগরী। সেখানে অপেক্ষায় ছিল আমার এইচ.এস.সি লাইফের বন্ধু ইকরাম হোসেন। তার সাথে ঘুরে দেখলাম প্লাটিনাম জুবেলী জুট মিলসহ অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। বেবী ট্যাক্সি আমাদের নিয়ে গেল বি.এল কলেজ। অসাধারণ। কলেজ
হলেও ক্যাম্পাসটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কোন অংশে কম না। লিটনকে সাথে নিয়ে ঘুরাঘুরি এবং ফটোসেশন শেষে শহীদ মুন্সি আব্দুল হালিমের স্মৃতি বিজড়িত মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। অ্যাপটেক হাউজে ফিরে মেসের সবাইকে নিয়ে নৈশভোজ। অকৃত্রিম আতিথেয়তা সবার।

২৬ জানুয়ারী ৮ টার দিকে বিদায় নেই শাহিন, আফজাল ভাই, পবিত্র দাদাসহ অ্যাপটেক হাউজের সবার কাছ থেকে। সোনাডাংগা থেকে বাস যোগে চুকনগর পৌঁছে যাই সাড়ে ১০ টায় । বিখ্যাত আব্বাস হোটেলে খাসির মাংস দিয়ে জমপেশ খাওয়া দাওয়া। আবার বাসে করে যশোরের কেশবপুর, তারপর সাগরদাঁড়ি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ী। সাগরদাঁড়ি! স্মৃতিময়, কেবলই মাইকেলের স্মৃতি বিজড়িত বলে নয়, বাদশাহি সভ্যতার নিদর্শন আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে চাইলেও আসতে হবে সাগরদাঁড়ি। যেখানে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বড় হয়েছেন, লিখেছেন কবিতা, দেখেছেন স্বপ্ন। যে স্থান কবির হাতে কলম তুলে দেয়, মানুষের মনকে করে তোলে স্বপ্নালু। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে জমিদার বংশের ছেলে ছিলেন তা তার বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। এর মধ্যে কিছু সংস্কারও অবশ্য করা হয়েছে। ১৯৪৪ সালে তৈরি মধুসূদন দত্তের একটি ইনস্টিটিউশন রয়েছে সেখানে। বাড়ির সামনে রয়েছে কবির একটি ভাস্কর্য। এর ঠিক নিচেই রয়েছে কবির লেখা একটি কবিতার কয়েক ছত্র। পাশেই রয়েছে মধুসূদন একাডেমির তত্ত্বাবধানে নির্মিত একটি মিনি মিউজিয়াম। এখান থেকে কবির জীবন এবং তার সৃষ্টি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানা যাবে। আরেকটু এগুলেই মধুসূদন গ্রন্থাগার। কবির লেখা বিভিন্ন বইপত্র রয়েছে সেখানে। 


সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত হে নদ তুমি রবে এ বিরলে
এই সেই কপোতাক্ষ নদ, যার মায়ায় কবি দূরদেশে বসে লিখেছেন অনেক কিছু। কবির বাড়ি থেকে অনতিদূরে অবস্থিত এই নদ যদিও আর আগের মতো প্রাণবন্ত নেই, তথাপি এর দুপাশের সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে যে কাউকে। নদীর পাড়ে কবির স্মরণে রাখা আছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। তখন চলছিল মধুমেলা। ঘুরে ঘুরে দেখা, সার্কাস উপভোগ, ফটোসেশন। মেশিন ভ্যানে চড়ে কপোতাক্ষ নদ, দীর্ঘ বাঁশের তৈরী সাঁকো পার হয়ে আবার মেশিন ভ্যানে পাটকেলঘাটা বাজারে পৌঁছলাম। এভাবে মেশিন ভ্যান, ইজিবাইক, পা ভ্যান। ৮ বার গাড়ী পাল্টিয়ে পৌঁছে যাই আমাদের বাড়ীতে। অপেক্ষায় ছিল সবাই। রাতে চিংড়ী খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি আরামে। অনেকটা নিশ্চিন্ত। তাই বিশ্রাম আর বিশ্রাম।

২৭ জানুয়ারী সকালে উঠে পিঠা খেয়ে রওনা দেই চিংড়ীর ঘের দেখতে। ঘের দেখে ভাগ্নে শরীফদের বাড়ীতে। বাড়িতে গেলে এখানে দু’এক বার আড্ডা হবেই। এবারের আড্ডায় নতুন মাত্রা রিপা। আরিফ মামার বৌ। একই প্রতিষ্ঠানে কোন সময় পড়া না হলেও সে আমার ক্লাসমেট। তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই সবাইকে। ঐতিহাসিক প্রেমের বর্ণনা শুনতে শুনতে শেষ হয় আড্ডা। হাটতে হাটতে আমাদের বাড়ী। তারপর চিংড়ী খিচুড়ী আর ডিম পোজ। পায়ে হেঁটে বাঁকা বাজার হয়ে অটো ভ্যানে কাটিপাড়া মাইকেল মধুসূদন দত্তের মামাবাড়ী। এখানে তার মামারা কেউ না থাকলেও জমিদার বাড়িটি আছে। তারপর ঐতিহাসিক রাড়ুলী কলেজ দর্শন ও অধ্যাপক আব্দুল মোমিন সানা’র সাথে আলাপচারিতা শেষে হালকা নাস্তা।

আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি স্যার পিসি রায়ের বাড়ী। "আমি বৈজ্ঞানিক, গবেষণাগারেই আমার কাজ, কিন্তু এমন সময় আসে যখন বৈজ্ঞানিককেও দেশের আহবানে সাড়া দিতে হয়।..." কথাটি বলেছেন জগদ্বিখ্যাত বাঙ্গালি বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট (বাংলা ১২৬৮ সালের ১৮ শ্রাবণ) এই অমর বিজ্ঞানী খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী রাড়ুলী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তিনি নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে, "আমি বৈজ্ঞানিকদের দলে বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী সমাজে ব্যবসায়ী, গ্রাম সেবকদের সাথে গ্রাম সেবক আর অর্থনীতিবিদদের মহলে অর্থনীতিজ্ঞ।" ১৮৮৫ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় "সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে" প্রবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পড়াশোনা শেষ করে প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং পরবর্তিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের গবেষণাগারে ১৮৯৫ সালে তাঁরই হাতে আবিষ্কৃত হয় "মারকিউরাস নাইট্রাইট" নামের দূর্লভ লবণ। এর মাধ্যমে সফল বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি মেলে তাঁর। এর পরে ১২টি যৌগিক লবণ ও ৫টি থায়ো এস্টার আবিষ্কার এবং ১৪৫ টি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন তিনি।


বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তুলতে তাঁর ছিল নিরলস প্রচেষ্টা। দেশে রসায়নশাস্ত্রের চর্চা এবং শিল্প কারখানা বিকাশের তাগিদে ১৮৯২ সাল থেকেই তিনি গবেষণা শুরু করেন এবং বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৪  সালের ১৬ জুন মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সেই মহান বিজ্ঞানীর জন্মস্থান এটি। শৈশব-কৈশোরের একটি বড় অংশই এখানে কেটেছে তাঁর। তাঁর পৈতৃক জমিদার বাড়িতে ঘুরলাম কিছুক্ষণ। তারপর একই অটো ভ্যানে বাড়ী ফিরে আসি। এরপর পাশের বাড়ীর ভাবীর হাতের গরম পিঠা ও ডিম ভাজী। আমাদের নিজস্ব কোন পুকুর নেই। তবে আছে আলাদা গোসলখানা, বৈদ্যুতিক মোটর ছেড়ে গোসলের ব্যবস্থা। সেখানেই একযোগে সবাই মিলে চলল গোসল। দুপুরে ইউনিয়ন জামাতের আমির ফোরকান ভাইয়ের আগমন। তাকে সাথে নিয়ে খাওয়া দাওয়া ও গল্প। তারপর হালকা বিশ্রাম। ৪ টার দিকে আমাদের গাছের ডাব খেয়ে রওনা দেই বাবুর পুকুরের উদ্দেশ্যে।

আমাদের এলাকার সবচেয়ে বড় স্বচ্ছ ও সুপেয় মিঠাপানির ভান্ডার এটি। পুকুরের দুই ধারে বৃটিশ আমলে তৈরি কারুকার্য খচিত ঘাট। কথিত আছে, পুকুরটি খনন করেছিল জ্বিনরা। তাই কখনো পানি ফুরায়নি, আর ফুরাবেও না। এখানে গোসল ও কাপড় ধোয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমনকি পা ডুবানোও নিষেধ। সেখানে ফটোসেশন শেষে কপোতাক্ষ তীর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দরগাহপুর সিদ্দিকীয়া মাদরাসা। এখানে পড়াশুনা করেছি পাঁচ বছর। অনেক আনন্দ ও কষ্টের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই প্রতিষ্ঠান। তখন আমার জন্য এখানে একটি রুম বরাদ্ধ ছিল। তালাবদ্ধ সে রুম দেখে ফিরে আসি ফোরকান ভাইয়ের খামারে। হালকা নাস্তা গ্রহণ শেষে বাড়ী ফিরি সবাই। তারপর পিঠা খেতে বসে যাই আমরা। গরম গরম পিঠা বেশ ভালোই লাগছিল। এমন সময় মোয়াজ্জিনের ডাক, এশার আযান। নামাজ শেষে রাতের খাবার। তারপর ঘুম।

অষ্টম দিন বা শেষ দিন। ২৮ জানুয়ারী বাদ ফজর। গরম ভাত খেয়ে রওনা দেই সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে। প্রথমে মেশিন ভ্যানে কূল্লা মোড়, তারপর বাস যোগে সাতক্ষীরা নিউ মার্কেট। পা ভ্যানে মোজাফ্ফর গার্ডেনে যখন আমরা তখন সকাল নয়টা বাজে। পিকনিক স্পট হিসাবে খুবই সুন্দর এটি। ভি আই পি ব্যবস্থাপনা আছে এখানে। ছোট বড় বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন ডিজাইনের পুকুর, দ্বীপ, চিড়িয়াখানা, বার্ড ভিউ পার্ক, প্রজাপতি পার্কসহ অসংখ্য দৃষ্টি নন্দন স্থাপনা আছে এখানে। পুকুরের উপর মসজিদ, যেন ভাসমান মুসলিম ঐতিহ্য। এখানেই বাড়ী থেকে আনা পিঠা দিয়ে সকালের নাস্তা করি। মাঝে মধ্যেই চলতে থাকে ফটোসেশন আর আড্ডা। তবে বিরক্তিকর ছিল ব্যাগগুলো। খুবই ভারী, তাই কষ্ট হচ্ছিলো। বিদায় নিলাম এখান থেকে। সাতক্ষীরার বিখ্যাত ঘোষ ডেয়ারী থেকে মিষ্টি ও দই খেয়ে উঠে পড়ি জনি পরিবহনে। সাড়ে ১২ টায় যাত্রা শুরু হয় রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। ৮ দিনের এই ভ্রমণের সবচেয়ে লং জার্নি এটি। কুষ্টিয়ায় এসে বিদায় নিল হাসান। রাত ৮টার দিকে পৌঁছে গেলাম রাজশাহীর বিনোদপুর। তারপর শুরু হলো সেই গতানুগতিক ধরাবাধা জীবন।

ফেসবুকে অগ্নিগিরি

সংবাদপত্র

পত্রিকার কলামসমূহ

বাংলা সাময়িকী

রবীন্দ্র রচনাবলী

নজরুল রচনাবলী

টেলিভিশন

জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সমূহ

অনলাইন রেডিও