নভেম্বর বিপ্লব : আমাদের সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ
ড. আব্দুর রহমান সিদ্দিকী

ভূমিকা
কোন সমাজের অভ্যন্তরে তথা রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বঞ্চনাবোধ দীর্ঘ শোষণ বঞ্চনা যখন নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অনিরুদ্ধ গণরোষে পরিণত হয় এবং তা ক্ষমতাসীনদের সমূলে উৎখাতের মধ্য দিয়ে সামাজিক রাজনৈতিক রূপান্তরের পথ ধরে জনগণ যে নব রাজনৈতিক-সামাজিক অভিযাত্রার সূচনা করে তাকে বলা হয় বিপ্লব।  অন্য কথায় বিপ্লব বলতে বোঝায় রাষ্ট্রের বিপুল জনগণের সশস্ত্র বা নিরস্ত্র, স্বতঃস্ফূর্ত ও আবেগঘন অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে, পুরাতন কোন নিবর্তনকারী শাসকদের পরাভূত ও উৎখাত করে সনাতন সমাজধারা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সবেগে ওলটপালট করে দিয়ে নয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের দ্বার উন্মোচন করে, এক নবতর রাষ্ট্র/সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের যুগান্তকারী ঘটনা সংঘটিত হয় তাকেই বলা হয় সামাজিক বিপ্লব।  
খ্যাতনামা রাজনৈতিক সমাজ বিজ্ঞানী Theda skoclpol  তার States and Social Revolutions  নামক গ্রন্থে সমাজ বিপ্লবের স্বরুপ ব্যাখ্যা করে বলেন, Ò…social revolutions involve the rapid transformation of a political system as well as the transformation of the class structure within the society” (1979).
 
একটি জাতি বা রাষ্ট্রের ইতিহাস এরকম বিপ্লব সাধারণতঃ একবারই সংঘটিত হতে পারে। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯), উনিশ শতকের প্রথম ভাগে বলশেভিক বিপ্লব (১৯১৭), মধ্যভাগে চীনা লাল বিপ্লব (১৯৪৯), বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কোরিয়ান বিপ্লব (১৯৫১), কিউবান বিপ্লব (১৯৬১), ও ইরানের ইসলামী বিপ্লব (১৯৭৯) যুগান্তকারী সমাজ বিপ্লবের একেকটি দৃষ্টান্ত। তদ্রƒপ বাংলাদেশের নভেম্বর বিপ্লব (১৯৭৫) ইতিহাসের একটি অনন্য উদাহরণ। এ এক অক্ষয় মাইল ফলক। 
বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের এক মহত্তম অর্জন হচ্ছে নভেম্বর বিপ্লব। জাতির ইতিহাসে এই বিপ্লব শুধু একটি গৌরবোজ্জ্বল স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হবে না জাতির অস্তিত্বের এক চিরন্তন রক্ষাকবচ হিসেবেও গণ্য হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে সংঘটিত হতে থাকা প্রকাশ্য ও গোপন, সামরিক রাজনৈতিক বহুমাত্রিক ও জটিল কতক ঘটনাবলীর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে নভেম্বর বিপ্লব। এই আকস্মিক ও স্বল্পস্থায়ী উথাল পাথাল বিপ্লবী কর্মকা-ে দেশপ্রেমিক জাতীয় সেনাবাহিনী ও স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্পৃক্ত হয়। বিদেশী আধিপত্যবাদীদের গভীর ব্যাপ্ত চক্রান্ত নস্যাৎ করে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণœ রাখার, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভৌগোলিক সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছিল এ ঘটনা। টানা প্রায় পাঁচ দিবস পাঁচ রাত্রিব্যাপী দেশের ভেতরে ও বাইরের নানান স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতায় সৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা প্রবাহের ইতিবাচক পরিসমাপ্তি ঘটে সাতই নভেম্বর প্রত্যুষে। বলা যায় এই সার্থক সমাপ্তির মধ্যদিয়ে জাতি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, চূড়ান্ত বিবেচনায় সার্বভৌম সত্তা অর্জন করে। ইতিপূর্বেকার সাড়ে তিন বছরে জাতি প্রচ্ছন্ন তাবেদারী চেহারা ধারণ করেছিল; যেমন ক্যাঙ্গারু রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিপন্ন হচ্ছিল অবিলম্বে তার অবসান ঘটে। এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জাতি বা রাষ্ট্রটি প্রকৃত স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তা হিসেবে বাস্তবরূপ লাভ করে সমাজ কাঠামোর কাঙ্খিত পরিবর্তনের পথ খুলে দেয়। 
দেশের প্রথাগত সেনাবাহিনীতে চাপাক্ষোভ সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে হতাশা ও অসন্তোষ স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবি শ্রেণী প্রভৃতি মুজিব প্রবর্তিত নয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে সমাজের নানা স্তরে, গহীন কন্দরে তীব্র আক্রোশ/ঘৃণা অব্যক্ত প্রতিবাদের এক ধূম্র কু-লী সৃষ্টি করেছিল। বাকশালের প্রত্যাবর্তন তাই কারো কাম্য ছিল না। দেখা গেছে পৃথিবীর সব স্বার্থক সমাজ বিপ্লবে বিক্ষুদ্ধ জনগণের সাথে দায়িত্বশীল সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হয়েছে এবং কাঙ্খিত বিপ্লবকে চূড়ান্ত রূপ দান করেছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয় নাই।

বিপ্লবের পটভূমি
দীর্ঘ চার দশক পর পিছন ফিরে তাকালে মহান নভেম্বর বিপ্লবের সমুজ্জ্বল রূপটি যেমন আরও স্পষ্ট ও মহিমান্বিত হয়ে ধরা দেয়, তেমনি সেই সব চক্রান্ত জাল বিছানো ধুয়াশাচ্ছন্ন দিনের ভয়াল স্মৃতিও দৃষ্টিপটে ভেসে উঠে।  মনে পড়ে এ বিপ্লবের গ্লানিময় পটভূমি এবং উৎকণ্ঠা উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা প্রবাহের কথা। 
অন্য যতোভাবেই বলা হোক না কেন একটি আত্মনির্ভরশীল ক্ষুধামুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণই ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল প্রেরণা, এজন্য জাতি চালিয়েছে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম। কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যারা একরূপ জোর করেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তারা জাতির কাঙ্খিত সেই স্বপ্নের সড়ক ধরে অগ্রসর না হয়ে অনুসরণ করে শত জঞ্জালময় বক্রপথ। ক্ষমতাসীন দল ও তাদের চ্যালাচামু-ারা অবিলম্বে বেপরোয়া লুটপাট ও ক্ষমতার চরম অপব্যবহারে উন্মত্ত হয়ে উঠে। তারা শহর বন্দর নগরে বাড়ীঘর, কল-কারখানা, জমি-জায়গা রাতারাতি জবর দখল করে নেয়। নির্লজ্জ লাইসেন্স পারমিটবাজি শুরু করে। যথেচ্ছ মজুতদারী, মুনাফাখোরী, চোরাকারবারী আরেক ধরনের অপলুণ্ঠনের দুয়ার খুলে দেয়। ধ্বসে পড়ার মুখে পৌঁছায় জাতীয় অর্থনীতি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত মানবের জন্য পাওয়া বিদেশী রিলিফ সামগ্রী সরকারী মহলকর্তৃক চুরি কিংবদন্তীর রূপ লাভ করে। দেশের শীর্ষ নেতাদের কাছের মানুষদের ছত্রছায়ায় চোরাচালানী একধরনের মচ্ছবের পর্যায়ে পৌঁছায়। হাইজ্যাক, রাহাজানি, গণপিটুনি, খুন-খারাবী হত্যাযজ্ঞ নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সর্বত্র আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অভাবিতপূর্ব অবনতি ঘটে। দেশ এক ভয়াল রক্তাক্ত উপত্যকায় পরিণত হয়। নানা শ্রেণী গোষ্ঠী লবি ও দূর্বৃত্ত চক্রের হাতে তখন অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানী। শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ তখন অসীম আতঙ্ক উৎকণ্ঠার মধ্যে ক্রমশঃ নিমজ্জিত হতে থাকে। কিন্তু এহেন নৈরাজ্য নৈরাশ্যের মধ্যে শাসক মহলের সুশাসন প্রতিষ্ঠার তেমন গরজ চোখে পড়ে নাই। সমাজে শান্তি শৃংখলা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য তেমন লক্ষণীয় তৎপরতা, দৌড় ঝাঁপ তাদের ছিল না। যুদ্ধোত্তর দেশটিকে বরং শাসকরা সবাই মিলে যেন মালে গনীমাত হিসেবে বিবেচনা করে দু‘হাতে লুটে নেয়ার কাজে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। এক কথায় দেশ জাতির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ তাদের ছিলনা। যেমন কথিত সোনালী আঁশ পাটকে নিয়ে জাতি বরাবর বড়াই করত, এই তাবেদার সরকার সেই পাটের হেড অফিস (ওঔঙ) ঢাকা থেকে বোম্বাইয়ে স্থানান্তরে মৌন অনুমোদন দিয়ে দেশের অর্থনীতির মেরুদ- অনেকটা ভেঙ্গে দেয়। এদিকে সরকার সমর্থকরাই সীমান্তের ওপারে পাট পাচারে লিপ্ত হলো। এর ফলে দেশের পাট কল গুলো হলো বন্ধ। এ দিকে চাল, ডাল, ভোজ্য তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হু-হু করে বেড়ে চলে যায় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এতে গণমানুষ হতাশ হয়ে পড়ে। তদুপরি এ রকম চরম হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির মধ্যে চলছে প্রশাসনের সর্বত্র চরম আত্মীয়করণ, দলীয়করণ, চলছে সকল কিসিমের আঞ্চলিকীকরণ, অবৈধ সব রকম ধান্ধা। শাসক দলের ছোট বড় নেতাদের প্রবল প্রভাবের অশুভ ছায়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কলুষিত ও স্থবির করে ফেলে প্রশাসন আমলাতন্ত্র বিচার বিভাগসহ সব কিছু। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে পরিণত করা হল আজ্ঞাবহ দলীয় প্রতিষ্ঠানে, তার মাধ্যমে মুখচেনা নেতাদের নামে রিক্রুট করা হয় আত্মীয়স্বজন ও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের। তাদের বানানো হলো ম্যাজিস্ট্রেট সাবজজ পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রজাতন্ত্রের বড় বড় পদে, প্রশাসনকে করা হল গৃহপালিতদের আখড়া। 
এতো কিছুর পরেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি শাসক মহল। নতুন করে শুরু হলো রাষ্ট্র ক্ষমতা চরমভাবে কুক্ষিগত করার কুৎসিৎ কারসাজি। স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মাথায় ১৯৭৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতি ও নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ব্যাপক কারচুপি, জালিয়াতি, মাস্তানী, ভোটচুরি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও নির্বাচনের ফলাফল ওলটপালটের এক জঘণ্যতম ইতিহাস সৃষ্টি করে। দেখা গেল সন্ধ্যায় নির্বাচিত ঘোষিত বিজয়ী প্রার্থীকে শেষ রাতে ফলাফল পরিবর্তন করে পরাজিত ঘোষণা করা হয়েছে। এটা ছিল আমাদের গণতন্ত্র বিকাশের ইতিহাসের এক জঘণ্যতম অধ্যায়। বলা যায় শেখ মুজিবের জীবদ্দশাতেই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ভোট ডাকাতি ও ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ঘৃণ্য কাজটি খুব দক্ষতার সাথেই লীগ সরকার সম্পন্ন করে। এ সবের পাশাপশি শুরু হয় বিরোধী দল দমন, পীড়ন, গ্রেফতার, হত্যা, গুমের আরেক পর্ব। এর আগেই বহু রাজনৈতিক দল ও নেতাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল, কেড়ে নেয়া হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকার। এ সবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার অতি অল্পকাল পরেই ক্ষমতার মসনদ চিরস্থায়ী করার খায়েশে যাবতীয় কায়দা-কানুন কাজে লাগায় ক্ষমতাসীন মুজিব সরকার। দুঃশাসনের আলামত ক্রমশঃ স্পষ্টতর  হয়ে উঠতে থাকে। গণতন্ত্র পরিণত হয় প্রহসনে, স্বাধীনতার স্বপ্ন যায় উবে। 
সদ্য স্বাধীন একটি দেশের সরকারের এসব কা-কারখানা দেখে মুক্ত বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন মানুষজন, দেশের চিন্তাশীল শ্রেণীসমূহ হতভম্ব ও হতাশ হয়ে পড়ে। অনতিকাল পরে জারি করা হলো বিশেষ ক্ষমতা আইন (১৯৭৪) প্রতিপক্ষের মুখ বন্ধ করার জন্য। অতঃপর মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার জন্য পাশ হলো সংশোধিত প্রেস এন্ড পাবলিকেশন এ্যাক্ট। কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হলো সংবাদপত্রের উপর, বাতিল করা হয় বহু পত্রিকার ডিক্লারেশন/প্রকাশনা। একে একে রুদ্ধ হতে থাকে গণতন্ত্রের সব দরজা। শেখ মুজিব প্রতিবাদী পক্ষগুলোকে রুখে দেওয়ার জন্য ‘লাল ঘোড়া’ দাবড়িয়ে দেওয়ার হুংকার দিলেন। প্রকাশ্যে নানাভাবে দেশের নির্ভীক ও সত্যাগ্রাহী মানুষদের শায়েস্তা করতে চাইলেন মুজিব সরকার। এসব মানুষদের নিয়ে যত ভয় শেখ মুজিবের- তাঁর সহচর আমলা ফয়লা ‘চাটার দল’-দুর্জন তস্করদের। দেখা গেল যারাই আওয়ামী দুঃশাসন ও লুটোক্রেসীর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চেষ্টা করছে একে একে তাদের অনেকের ঠাঁই হলো কঠিন কারান্তরালে। ড. আলীম আল রাজী, মেজর জলিল, মওলানা ভাসানী, কবি আল মাহমুদ, ড. আফতাব আহমেদ এমনি আরো অনেক নিখাদ দেশ প্রেমিক, স্বাধীনতাপ্রিয় সাহসী ব্যক্তিদের পাঠানো হলো কঠিন গরাদেও ভেতরে। কিন্তু এতো কিছু করেও আওয়ামী মহল নিশ্চিন্ত হতে পারে নাই যে, তাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুুষ হলো কি-না। তাদের ক্ষমতা লিপ্সা, লোভ-লালসা দাপট দৌরাত্ম্যের তবু নিবৃত্তি হয় নাই । জাতির জন্য অপেক্ষা করছিল আরো দুঃসহ দুর্দশা, আরো মর্মন্তুদ নানা ট্র্যাজেডী আর ভয়ানক নিপীড়ন অপশাসন। এইসব ডামাডোলের মধ্যে ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে দেশে সৃষ্টি হয় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। বিশেষভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে শতবর্ষ পরে এক অভাবনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় । তখন সাধারণ মানুষের কাজ নাই, হাতে টাকা নাই, খাদ্য নাই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘিরছে। চারদিকে খাদ্যের জন্য হাহাকার। নিদারুণ ক্ষুধা গ্রাস করে জনপদের পর জনপদ। লাখো আদম সন্তান নিরন্ন ক্ষুধার্ত। কঙ্কালসার হাজারো নারী পুরুষ বৃদ্ধ শিশুর মিছিল এসে পৌঁছায় শহরে বন্দরে, রেল স্টেশনে, হাটে-বাজারে। মানুষ আর কাক-কুকুরে ডাস্টবিনের পঁচা পরিত্যক্ত খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ির অবস্থা। দেখা গেল ক্ষুধার্ত মানুষ চেটে খায় অন্যের বমি। নিত্যদিন ক্ষুধার কাছে পরাজিত মানুষ শত শত মরে পড়ে থাকে শহরে বন্দরের রাজপথে। রাজধানীসহ বড় বড় শহরের রাজপথে, পার্কে, হোটেলের সামনে, বড় বড় রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে দুর্ভিক্ষ তাড়িত হতভাগা মানুষের লাশের ছড়াছড়ি। কিন্তু এসব বিষয়ে রাষ্ট্র ভয়ানক উদাসীন, সরকার দায়দায়িত্বহীন। এসব দুর্ভাগাদের লাশ দাফনের গরজ দেখা গেল না, কোন ব্যবস্থা সরকার করে নাই। এসব বেওয়ারিশ লাশের কোন সঠিক হিসাবও কেউ জানে না। দায়সারা সরকারী এক হিসেব মতে, কেবল উত্তরাঞ্চলেই ২৬ হাজার আদম সন্তান বেঘোরে ক্ষুধায় প্রাণ হারিয়েছে। মতান্তরে এই সংখ্যা এক লক্ষের কাছাকাছি। একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসাব বক্ষমান নিবন্ধকারের ধারণা এই সংখ্যার কয়েক গুণ বেশী হবে। এই ভয়ানক দুর্ভিক্ষে যে মানবীয় বিপর্যয় ঘটে তাতে শাসক মহল বিচলিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় নাই, চোখে পড়ে নাই তাদের কোন উৎকণ্ঠা উদ্বেগ, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ছিলনা জোর তৎপরতার কোন আলামত ইঙ্গিত। বরং তখনও ঘাটতি নাই মুজিব তোষণে, লুণ্ঠন বা দখলদারীর দৌরাত্ম্যের কোন কমতিও ঘটে নাই। পরন্তু মুজিববাদী তর্জন গর্জন আর ‘বজ্রকণ্ঠের’ অসার আস্ফালন আবেশে দেশবাসীকে আচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা চলছে। অথচ অমর্ত্য সেনসহ গবেষকগণের মতে ১৯৭৪ এর এই দুর্ভিক্ষ ছিল সম্পূর্ণরূপে মানব সৃষ্ট এক বিপর্যয়। এটাছিল তৎকালীন সরকারের  প্রশাসনিক ব্যর্থতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। তাদের উদাসীনতা, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অথর্বতা, দায়িত্বহীনতা, উপেক্ষার, দুর্নীতির নিষ্ঠুর বহিঃপ্রকাশ ছিল এই বেদনাবহ  দুর্ভিক্ষ। বস্তুতঃ তখন দেশে খাদ্যাভাব ছিলনা। ছিল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সদিচ্ছার অভাব, ছিল সুশাসনের অনুপস্থিতি। আর তাই দুর্ভিক্ষের দানব কেড়ে নিতে পেরেছিল লক্ষ নিরীহ মানুষের প্রাণ।
পরিহাসের বিষয় এই যে , এই ভয়ানক দুর্যোগের অল্প কয়েক মাস পরেই দুই রাজকুমার শেখ জামাল, শেখ কামালের শাদী মুবারক আয়োজন করা হল মহাধুমধামে। আয়োজন ছিল রাজসিক। আন্দাজ করা যায় তাতে খরচা করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। অপচয় হয়েছে বিপুল পরিমাণ খাদ্য পানীয়ের। নিমন্ত্রিত হয়ে এলেন হাজারে হাজারে দলীয় নেতা নেত্রী ও পছন্দের বিশেষ ব্যক্তিবর্গ। হোটেল শেরাটনের প্রান্ত থেকে লেডিস ক্লাবের অভ্যন্তর পর্যন্ত মুড়ে ফেলা হল রেড কার্পেটে। ঝলোমল আলোক সজ্জা আর জাকজমক দেখে মনে হল এই দেশ কী সেই দুর্ভিক্ষ তাড়িত কোটি প্রাণ কেড়ে নেয়া দেশ! সেই দেশের রাজ পুত্রদের চোখ ধাঁধানো  বিবাহ বাসর এই! হাজারও সরকারী কর্মকর্তা  পুলিশ গোয়েন্দা, ট্রাফিক কর্মী, জানপ্রাণ দিয়ে খেটে সাড়ম্বরের সমাপ্ত করে দিলেন মুজিব পুত্রদয়ের বিবাহ অনুষ্ঠান। একজন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী হিসাবে বর্তমান নিবন্ধকার সব কিছু স্বচক্ষে দেখে শুনে বেদনায় বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে ভেবেছি, এই কি সেই বাংলাদেশ, যে দেশে মাত্র কিছু দিন আগে ক্ষুধার্ত মানুষ মানুষের বমি চেটে খেয়ে বাঁচতে চেয়েছে, এই কি সেই দেশ, যেখানে কাফনের কাপড়ের অভাবে কলাপাতায় মুড়ে লাশ দাফন করতে হয়েছে! এই কি সেই দেশ, যেখানে যুবতী বাসন্তী রাণী লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড় না পেয়ে মাছ ধরা জাল পরিধান করে নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছে! এ সব দেখে পরম বিধাতা বুঝি অলক্ষে হেসেছেন। এত ব্যথা এত অবহেলা এত গ্লানী ও মানবতার এমন গভীরতর অবমাননার প্রতিবিধান দেয়ার জন্য ৩৬৫ দিনও তিনি দেরি করেন নাই।
ক্ষমতাবানরা রাতের আধারে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক লুণ্ঠন, বাড়ি ঘর, কল-কারখানা দখলদারি আর অসহনীয় দৌরাত্মের পাশাপাশি গণপীড়ন, অবদমন, জুলুমবাজির লেলিহান জিহ্বা ত্রুমাগত প্রসারিতই করে নাই, ক্ষমতার লিপ্সা ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিবারের কুক্ষিগত করার, দলীয় সম্পত্তিতে পর্যবসিত করার জন্য শুরু হয় আরেক চক্রান্ত। ইতিমধ্যে দলীয় দুর্ধর্ষ দুর্দান্ত তরুণ ক্যাডার মাস্তান ষ-া পা-াদের জড় করা হলÑগড়ে তোলা হল কুখ্যাত রক্ষী বাহিনী। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রতিবাদী নেতা-নেত্রী সত্যনিষ্ঠ তরুণ সম্প্রদায় আর বিক্ষুব্ধ জনসাধারণকে স্তব্ধ ও নিশ্চিহ্ন করার কাজে লিপ্ত হয় রক্ষীবাহিনী নামে নয়া নাৎসী বাহিনী। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব এদের গড়ে তুলেন তার নিজের পরিবার পরিজন ও দলবলকে সুরক্ষা দিতে আর ক্ষমতার মসনদকে চিরস্থায়ী করার পথকে নিষ্কণ্টক রাখতে। এই পেটোয়া বাহিনীও অতন্ত বিশস্ততার সাথে প্রভুর আকাঙ্খা, আদেশ-নির্দেশ পালনে দেশের পথে প্রান্তরে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এরা প্রতিবাদী বা ভিন্ন মতাবলম্বীদের নির্মূলের কাজ করতে থাকে মহা উৎসাহে, নিষ্ঠুরতার সাথে। এই জঘণ্য ঠেঙ্গাড়ে বাহিনীর হাতে বেঘোরে প্রাণ হারায় হাজার হাজার নবীণ তরুণ রাজনৈতিক কর্মী। সিরাজুল আলম খান, কর্ণেল তাহের, হাসানুল হক ইনুসহ ভাবশিষ্য অগণিত তরুণদের অনেকেই নিখোঁজ হয়ে যায়। কথিত ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’ বিশ্বাসী জাসদ সমর্থকরা হয়ে উঠে রক্ষীবাহিনীর অন্যতম টার্গেট, হয় নির্মম গণহত্যার শিকার। এছাড়াও রক্ষিবাহিনীর হাতে প্রাণ হারায় বহু বহু সাধারণ মানুষ, পঙ্গু হয়ে যায় অনেকে, কারাগারে ঠাঁই হয় অগণন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের। তখন পুরো দেশ যেন এক পুলিশি রাষ্ট্র, সারাদেশ যেন এক মহাকারাগার। কথিত সোনার বাংলা পরিণত হয় এক মহাশ্মশানে।

মুজিববাদ ও প্রাসাদ যড়যন্ত্র
প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৫ সালের সূচনালগ্নে মাত্র কয়েক মিনিটের আলোচনায় দেশের রাজনৈতিক দর্শন ও কাঠামোকে দিলেন বদলে। দেশে কায়েম করলেন এক দলীয় ব্যবস্থা, বাকশাল। বাতিল করা হল সব রাজনৈতিক দল। এজন্য কোন  রেফারেনডাম, জনমত যাচাই বা রাজনৈতিক সংলাপের প্রয়োজন তিনি বোধ করেন নাই। প্রবর্তন করলেন অভিনব মস্কোপন্থি সমাজতন্ত্র। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নুহুল আলম লেনিন, মহিউদ্দিন মনি সিং প্রমুখ কমরেডগণ ছিলেন মূল বুদ্ধিদাতা। তখন দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দর্শন হলো “এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ”। আর কোন নেতা নেই, ভিন্ন কোন আদর্শ বা দর্শন চর্চা চলবেনা। মুজিব হয়ে বসলেন একচ্ছত্র ক্ষমতাধর একমাত্র নেতা, মহানায়ক। তথাকথিত “মুজিববাদের” তত্ত্ব গৃহিত হলো রাষ্ট্রীয় দর্শন হিসেবে। মুজিব নিজে বিনা নির্বাচনে হয়ে বসলেন প্রজাতন্ত্রের নয়া প্রেসিডেন্ট। ভাবখানা এমন যে, তিনি আজীবন এমনকি বংশ পরম্পরায় রাষ্ট্র শাসক হিসেবে থেকে যাবেন। এভাবেই গণতন্ত্র হত্যা করে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে শেখ মুজিব চিরস্থায়ী ভাবে মসনদ আঁকড়ে থাকার বন্দোবস্ত করে ফেলেন। আরও কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, বাকশাল কেবল রাজনৈতিকদেরই আস্তানা নয়। আইনজীবি অধ্যাপক চিকিৎসক ব্যবসায়ী আমলা কর্মকর্তা এমনকি উর্ধ্বতন সাময়িক কর্মকর্তাদেরও বাকশালের কালো ছাতার নিচে আশ্রয় নিতে বলা হল। যারা বাকশালে যোগ দেবেননা তারা বিবেচিত হবেন ভিন্নমতাবলম্বী, বিদ্রোহী হিসেবে; বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্যহীন ব্যক্তি হিসেবে, তার প্রতিপক্ষরূপে। বলা যায় নানা মর্যাদা স্তর মত পথ ও চিন্তার লোকদের জোড় করে বাকশালে যোগ দিতে বাধ্য করা হলো। এর পরের ইতিহাস কমবেশি সকলেরই জানা।

সেনাবাহিনীর একাংশের হাতে আত্মীয় পরিজনসহ রাষ্ট্রপতি ও বাকশালের চেয়ারম্যান শেখ মুজিবর রহমানের আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যুতে দেশ-বিদেশে বিশেষ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় নাই। বরং অবিলম্বে আওয়ামীলীগের শীর্ষ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও বাকশাল মর্যাদা কাঠামোর চতুর্থ ব্যক্তিত্ব খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে আওয়ামী-বাকশালীদের একাংশ শেখ মুজিবের রক্তের দাগ শুকিয়ে যাবার আগেই গণভবনে নতুন সরকার গঠন করে। তারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হাতে তুলে নেন মুজিবের লাশ দাফন করার আগেই। মুজিব মন্ত্রিসভার ২৮ জনের মধ্যে ১৯ জনই মোশতাকের নয়া মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। সেনাবাহিনী সহ তিন বাহিনীর অধিনায়কগণ (এ কে খন্দকারসহ) নয়া সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে মিডিয়ায় বিবৃতি প্রদান করেন। যে রক্ষীবাহিনীকে একটি দলীয় বা পারিবারিক পেটুয়া বাহিনী হিসেবে গঠন করা হয়েছিল তারাও সে দিন চুপসে যায়, নিষ্ক্রিয় থাকে। আর প্রতিবাদহীন নির্বিকার হয়ে আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যান রক্ষীবাহিনীর বাঘা বাঘা উপদেষ্টাগণ। 
রাতারাতি দেশের ভিতরের হাওয়া যেন বদলে যায়। সকল প্রকাশ্য মহল বা স্তরে এক ধরণের স্বস্তির আবহ সৃষ্টি হয়। বিশেষভাবে সংবাদপত্রের জগতে নব উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। বাতিল হয়ে যাওয়া সংবাদপত্র সমূহ নব উদ্যমে পূণরায় আত্মপ্রকাশ করে। রাজনৈতিক পরিম-লেও গুণগত পরিবর্তনের আভাস পরিস্ফুট হয়ে উঠতে থাকে। 
বাকশালী দুঃশাসন থেকে বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশের লক্ষকোটি জনতা যখন নীরব আনন্দের জোয়ারে ভাসছে, স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির উল্লাসে উদ্বেল, আধিপত্যবাদের অপচ্ছায়া থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার স্বাদ লাভে উদগ্রীব তখন ভিন্নতর একটি মহল গোপনে গোপনে ষড়যন্ত্রের জট পাকানোর কাজে লিপ্ত ছিল। নব্য সম্প্রসারণবাদের তাবেদাররা, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পদলেহনকারীরা তখন ক্যান্টনমেন্টের ভিতর বাইরে চক্রান্ত পাকিয়ে তুলছিল অলক্ষে। 
অবিলম্বে বাতিলকৃত সংবাদ পত্রগুলো গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, নয়া সরকারের অনুমোদনে নব উদ্যমে প্রকাশ হতে থাকে। দেশের অবদমিত ও নির্যাতিত বামধারার দল গুলো তখন ঘাপটি মেরে থাকে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারীরাও চুপ হয়ে যায়। আর আওয়ামীলীগের অবশিষ্টাংশ একদম খামশ হয়ে যায়। কোন উচ্চ বাচ্য না করে বরং বহুদা বিভক্ত ও গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকে। জাতির অভিভাবক মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর মত উচ্চকণ্ঠ মানুষও রইলেন নির্বিকার। এভাবে বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়ে যায় শেখ মুজিব ও তার ধিকৃত বাকশাল। আর দেশের লাখো কোটি আম জনতা অনির্বচনীয় এক প্রসন্ন বোধে আরোও অধিকতর মৌনতা অবলম্বন করে, হাফ ছেড়ে বাঁচে। দুঃশাসনের মেঘ কেটে যেন রৌদ্র করোজ্জ্বল দিনের সাক্ষাত পায় তারা। 
স্পষ্টত: আন্তর্জাতিক মহলেও এই ঘটনার কোনরূপ উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না। এমনকি প্রতিবেশী ভারত সরকার ও ঢাকায় ক্ষমতা দখলকারী নতুন সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিয়ে ভবিষ্যতে একযোগে কাজ করার প্রকাশ্য অঙ্গিকার ব্যক্ত করে। অনুরূপভাবে বিদেশী নামীদামী বহু পত্র পত্রিকায় বাকশালী রেজিমের পতনের ইতিবাচক সংবাদ বা বিশ্লেষণ পরিবেশন করে। বলা যায় বাকশাল ব্যবস্থা তথা এর শীর্ষ প্রবর্তকদের দৃশ্যপট থেকে আকস্মিক ও রক্তাক্ত বিদায়কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আদৌ সিরিয়াসভাবে গ্রহণ করে নাই। উপরন্তু এর পরেই কতিপয় প্রভাবশালী দেশ যেমন সৌদি আরব, গণচীন প্রভৃতি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। 

বিপ্লবের দৃশ্যপট
শেখ মুুজিবর রহমানের অচিন্তনীয় মৃত্যুতে তার সাধারণ ভক্ত অনুরক্ত অনুগামীবৃন্দ ও দুর্ধর্ষ রক্ষাবাহিনীর অধিনায়ক ও দুর্দান্ত বাকশাল কর্তারা একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়; যেন কোথাও কেউ নেই, কোন কিছু ঘটে নাই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটি ক্ষমতালিপ্সু কুচক্রি মহল তাদের বিদেশী প্রভূ/মিত্রদের সহায়তার সমর্থনে অলক্ষে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছিল। আওয়ামী বাকশালী শাসনকে পূনর্বহাল করার প্রচ্ছন্ন অভিপ্রায়ে তারা পর্দার অন্তরালে তৈরী হতে থাকে। তারা সম্ভবত অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিল। তাইমাত্র ৮৯ দিনের মাথায় (৩রা নভেম্বর, ১৯৭৫) সরকার তথা রাষ্ট্র প্রশাসনের উপর পাল্টা আঘাত হানে সামরিক বাহিনীর অন্যতম শীর্ষকর্তা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। হঠাৎ হামলে পড়েন প্রেসিডেন্ট মোশতাক ও তার সরকারের উপর। দ্রুত দখল করে নেন রেডিও বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ টেলিভিশন কেন্দ্রসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ব্রিগেডিয়ার খালেদ অবিলম্বে নিজেকে মেজর জেনারেল হিসেবে ঘোষণা করেন। সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াকে অবিলম্বে পদচ্যুত ও গৃহবন্দি করে ফেলেন, ক্ষমতাচ্যুত করেন প্রেসিডেন্ট মোশতাককে। নিযুক্ত করেন বিচারপতি সায়েমকে নয়া প্রেসিডেন্ট। জেনারেল খালেদ মোশাররফ নতুন করে জারি করেন সামরিক আইন, নিজেই হন উপসামরিক আইন প্রশাসক। এ সময় গণভবন সেনানিবাস রাষ্ট্রীয় মিডিয়া কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কারাগার প্রভূতি স্থানে দ্রুত ঘটতে থাকে নানান অভূতপূর্ব ঘটনা। হঠাৎ সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশ রেডিও, ঢাকা টেলিভিশনের। সর্বত্র গুমোট এক পরিস্থিতি, নানা গুজব গুঞ্জন মুহূর্মুহূূ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দেশের জনগণ বিশেষতঃ ঢাকার বাসিন্দাগণ বক্ষমান প্রবন্ধকারসহ অন্তহীন উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় পার করতে থাকেন। এদিকে ঢাকার এই পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের খবর ভারতীয় রেডিও সংবাদপত্রে খুব উৎসাহ উচ্ছ্বাসের সাথে প্রচার করা হতে থাকে। জেনারেল খালেদ মোশাররফের এই ক্যুর প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। বিশেষভাবে কলকাতার মিডিয়ায় যেসব মন্তব্য/অভিমত প্রচার করা হয়, তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে জেনারেল খালেদ মোশাররফের প্রতি ভারতের সহানুভূতি সহায়তা রয়েছে। তার এ অভ্যুত্থানের পিছনে ভারত রয়েছে। জনগণ মনে করে যে জেনারেল খালেদ রুশ/ভারত অক্ষশক্তির পক্ষে একজন হিসেবেই কাজ করছেন। ফলে জনমনে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে মোশাররফ ভারতের হয়ে, ভারতের স্বার্থে এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। তদুপরি বিদ্রোহিদের নেতা খালেদ মোশারফ এর বোলচাল ও ভাবভঙ্গি থেকেও ঐ একই ধরনের ঈঙ্গিত পাওয়া যায়। এছাড়াও খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানের ও ক্ষমতা দখলের ফলে আওয়ামীলীগের মধ্যে সহসা অতিচাঞ্চল্য ও উল্লাস উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়। বাকশালী ঘরানার কতিপয় কবি বুদ্ধিজীবি সর্মথক তৎপর হয়ে ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবির চৌধুরি, ড. নিলীমা ইব্রাহিম, কবি সুফিয়া কামাল প্রমূখ মুখচেনা রুশ/ ভারত সর্মথক ব্যক্তিবর্গ এবং জেনারেল খালেদ মোশাররফের মা ও ভাইয়ের নেতৃত্বে ঢাকা রাজপথে খালেদের পাল্টা অভ্যুত্থানের পক্ষে সংক্ষিপ্ত অথচ সরব মিছিল বের করা হয় নীলক্ষেত এলাকায়। তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের  প্রতি নানা রকম হুমকি হুঙ্ক্ার উচ্চারণ করে অধিকতর আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। মনে হয়, তবে কি আবার বাকশালী শাসনের দিন ফিরে আসছে? এ সবের ফলে দেশের জনগণের মধ্যে গভীর উদ্বেগ-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, হয়ত বা অভ্যুত্থানকারী/বিদ্রোহিদের পক্ষে শক্তিমান প্রতিবেশী সামরিক হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে। জেনারেল খালেদ মোশাররফ বুঝি ওদেরই হাতের হাতিয়ার, রুশ/ভারতের এক বংশবদ তাবেদার। দেশপ্রেমিক জনসাধারণ আশঙ্কা করে যে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আজ বুঝি বিপন্ন। এ দেশীয় তাবেদারের সহযোগিতায় দেশজাতি হয়তবা আটকা পড়তে যাচ্ছে নয়া সম্প্রসারণবাদী শক্তির জালে। সমগ্র জাতি এমতাবস্থায় উত্তেজনা অনিশ্চয়তা ও গভীর উদ্বেগের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। এহেন ডামাডোলের মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাতে ঘটে জাতীয় চার নেতার রহস্যময় হত্যাকা-। ভোর থেকে ভবনের উপর চক্কর দেয় সামরিক হেলিকপ্টার, ঘনীভূত হয় রহস্য, সন্দেহ সংশয় উৎকণ্ঠা। রাজধানীর জনজীবন এক রকম থমকে যায়।

এদিকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে একই সমান্তরালে অন্যত্র ঘটতে থাকে অন্যান্য ঘটনা। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তৎপর হয়ে উঠে কর্ণেল (অব) তাহেরের অনুগত কথিত ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার’ সিপাহীরা। কর্ণেল তাহের ও তার সাঙ্গরা গোপনে ১৯৭২ সালের দিক থেকেই জাসদ ও গণবাহিনী  সংগঠিত করছিল মুজিবীয় শাসনের বিপরীতে। তারা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কায়েম করতে চায়; খাঁটি মার্কসবাদ তাদের মূলমন্ত্র। প্রকাশ্য রাজনীতির ময়দানে এরা অবিলম্বে আওয়ামী সরকার তথা রক্ষীবাহিনীর প্রচ- রোষানলে পড়ে। জাসদের নেতা কর্মীরা বেধড়ক মারা পড়তে থাকে দেশজুড়ে। তাদের হাজার হাজার তরুণ কর্মী সমর্থক মারা পড়ে রক্ষীবাহিনীর হাতে। কর্ণেল তাহের সেনাবাহিনীতে তার একটি ক্ষুদ্র অনুসারী চক্র তৈরী করেছিলেন। কর্ণেল তাহের ও তার অনুগামীরা সেনাবাহিনীতে শ্রেণী শত্রু খুঁজে পান, দেশে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ প্রতিষ্ঠার পথে তারাই নাকি হয়ে উঠেছিল অন্তরায়। কাজেই তাদের খতম করাই ছিল ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার’ প্রধান লক্ষ্য।

জেনারেল খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের সুযোগে তাহের অনুসারীরা সহসা ধুয়াসার মধ্যে শ্রেণী শত্রু নিধনে (অফিসার হত্যা) লিপ্ত হয়। এতে আরেক দফা ক্যান্টনমেন্টে ভিন্ন রকমের এক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে, চরম বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। এমনিতেই শেখ মুজিবের শাসনামলে সেনাবাহিনী নানা উপেক্ষা অবহেলার স্বীকার হয়েছিল। তাদের মধ্যে সঞ্চিত হয়েছিল নানাবিধ ক্ষোভ বঞ্চনা। এদিকে খালেদের অভ্যুত্থান চেষ্টার মধ্যে বিশৃংখল ও বিভ্রান্ত সিপাহীদের কাঁধে পা রেখে মার্কসবাদের নামে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে উদ্যোগী হয় কর্ণেল তাহের চক্রটি। এরা সিপাহিদের ক্ষেপিয়ে ক্ষমতা দখলের পায়তারা করতে থাকে। এরা বরাবরই মুজিববাদী শাসনের বিরোধীতা করেছে। কাজেই নতুন পরিস্থিতিতে তারা ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল খালেদ মোশাররফকেও প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে। বাতাস বুঝে এরা খালেদ মোশাররফকে বিদেশী এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করে, ক্যান্টনমেন্টে বিশৃংখল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এর সুযোগ নিতে তৎপর হয়ে ওঠে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা সংহত করার পূর্বেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা অ্যাকশনে যায় এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে তৎপর হয়ে ওঠে। 

এভাবে ক্ষমতার সামরিক বেসামরিক কেন্দ্র সমূহে এবং শহরে ঘরে বাইরে জনগণের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি, গুজব ও শংকার ধূ¤্রজাল ঘনীভূত হতে থাকে। নভেম্বরের ৩, ৪, ৫ তারিখের দিকে রাষ্ট্র বস্তুত সরকারহীন এক দশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। একদিকে উচ্চ বিলাসী জেনারেল খালেদ মোশাররফ সাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে সামরিক জান্তার উত্থান অন্যদিকে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ প্রবক্তাদের হট্টগোল হাঙ্গামার মধ্যে ক্ষমতা দখলের রক্তাক্ত কা- কারখানা সমগ্র ঘটনা প্রবাহকে দ্রুত অনিবার্য পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। 
এহেন ভয়ংকর ও বিশৃংখল পরিস্থিতির মধ্যে কয়েক দিবস ধরে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ছিলেন গৃহবন্দি দশায়। খালেদের অনুগত মুষ্ঠিমেয় সৈনিকরা তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। হয়তো সুযোগমত তাকে এক পর্যায়ে হত্যা করা হতো। বিভ্রান্ত সামান্য সংখ্যক ব্যক্তি ছাড়া সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সৈনিক ও অফিসারগণ ছিলেন দেশ প্রেমিক এবং তারা জেনারেল জিয়ার কমান্ড ও কর্তৃত্বের প্রতি ছিলেন অনুগত। জেনারেল মোশাররফ ও কর্ণেল তাহেরদের দ্বিমুখী চক্রান্ত ও চাপের মুখে প্রকৃত দেশপ্রেমিক সৈনিকগণ আকস্মাৎ আগুয়ান হয়ে ওঠেন, পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে মুহূর্তে ঘুরে দাড়ান তারা। বিশেষভাবে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারীর সদস্যগণ ৬ নভেম্বর এর মধ্যরাতে অবরুদ্ধ সর্বাধিনায়ক জেনারেল জিয়াকে উদ্ধারের জন্য অগ্রসর হলে খালেদ মোশাররফের অনুগত প্রহরারত সৈনিকরা বেগতিক বুঝে রণভঙ্গ দিয়ে দ্রুত পলায়ন করে। অবিলম্বে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা হয়। অতপর অতিদ্রুত দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। মুক্ত জিয়া সহযোদ্ধাদের দ্রুত কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। তার সাথে যোগ দেন অধিকাংশ দেশপ্রেমিক অফিসার ও সৈনিকগণ। এতে মুহূর্তে মুহূর্তে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। আর বহুলাংশে কমান্ড ও কন্ট্রোল ফিরে আসে জিয়া ও তার অনুসারীদের হাতে। 

শেষ দৃশ্য
৩রা নভেম্বর থেকে যেসব ঘটনা রাষ্ট্রের উচ্চকোটিতে একের পর এক ঘটে যাচ্ছিল, তা গোপন থাকেনি। জনসাধারণের কানে নানা ভাবে তা পৌঁছে গেছে। প্রথমে মানুষের মধ্যে কানাঘুষা, অতপর উৎকণ্ঠা উত্তেজনা এবং অবশেষে জনমনে এই প্রতীতি জন্মায় যে, বিদ্রোহী খালেদ চক্র বিদেশীদের এজেন্ট, রুশ ভারতের দালাল। অবশেষে ৬ই নভেম্বর শেষ রাতে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার তাগিদে আপনা থেকে দেশ প্রেমিক লাখো মানুষ জেগে উঠে। ক্যান্টনমেন্টের কোলাহলের পাশাপাশি নিজ নিজ বাড়ী ঘর পাড়া মহল্লা ছেড়ে তারা নেমে আসে রাজপথে। তারা জাতির ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় লিপ্ত কুচক্রিদের বিরুদ্ধে, বিদেশীদের তাবেদারদের বিপক্ষে দাড়ায়। দেশ জাতিকে তারা কোন আধিপত্যবাদিদের পদানত হতে না দিতে বদ্ধপরিকর। ক্যান্টনমেন্টের ভিতরেও ততক্ষণে জেনারেল খালেদ গংয়ের কমান্ড কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। তার অনুসারীরা ছত্রভঙ্গ ও আত্ম রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত। স্বয়ং খালেদ মোশাররফও ততক্ষণে রণভঙ্গ দিয়েছেন। পলায়নপর খালেদ মোশাররফ অবিলম্বে তার মুষ্টিমেয় সহচরসহ নিহত হন। 
কর্ণেল তাহের ও তার অনুগামী সৈনিকরা ততক্ষণে এলোপাথারী অনেক রক্তপাত ঘটিয়ে অনাসৃষ্টি করে ফেলেছিল। শ্রেণী শত্রু খতমের ভুয়া তথ্য প্রচার করে ওরা সেনাবাহিনীকে অফিসার শূন্য তথা কর্তৃত্বহীন বিশৃংখল ও দুর্বল করার মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার এবং বিজাতীয় আগ্রাসনের অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে ফেলেছিল। জেনারেল জিয়ার আকস্মিক মুক্তিলাভ ও প্রত্যুপন্নমতিত্ব এবং পরিস্থিতির তড়িৎ গুণগত পরিবর্তনে বোধকরি বিপ্লবী সৈনিক ও তার কর্ণধারদের মধ্যে শংকা সৃষ্টি হয়ে থাকবে। তারা অনুধাবন করে এতক্ষণে খালেদ মোশাররফ যদি ক্ষমতা সংহত করতে পারে তবে তাদের (সৈনিক সংস্থা) কপালে মহাদুর্গর্তি দুর্ভোগ আছে, চামড়া বাচানো হয়তো সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতিতে উপায়ান্ত না দেখে জিয়ার উদ্ধারকারী ও অনুগতদের সাথে কর্ণেল তাহেরের অনুসারী সিপাহীরা ভিড়ে যায়। কর্ণেল তাহের প্রমূখ জেনারেল জিয়ার সাথে যোগাযোগ করে ও হাত মেলায়। দেশ প্রেমিক সৈন্যরা ইত্যবসরে ঘুরে দাড়ানোতে বিপ্লবের চূড়ান্ত মুহূর্ত সমুপস্থিত হয়। অতি প্রত্যুষে ব্যারাক থেকে দেশপ্রেমিক সৈন্যদের কনভয় বিজয় উল্লাস করতে করতে বের হয়। আর পথে পথে ততক্ষণে জড় হওয়া উৎকণ্ঠিত জনগণ তাদের সাথে সানন্দে যোগ দেয়। তখন সৈনিক ও জনতার হৃদয়ে একই অনুভূতি, অভিন্ন উপলদ্ধি। একই আকাঙ্খার স্বপ্ন চোখে মেখে সৈনিক জনতা একাত্ব হয়ে যায়। কাকডাকা ভোরেই জনতা ও সৈনিকদের এই মহা মিলনের এক বাঁধভাঙ্গা জোয়ার যেন জাগে। সমস্ত আতঙ্ক নৈরাজ্য হানাহানির বৃত্ত ভেঙ্গে সিপাহী ও জনতা একাকার হয়ে যায়। তারা সম্মিলিত কণ্ঠে গগণবিদারী স্লোগান দেয় সিপাহী জনতা ভাই ভাই, নারায়ে তাকবির আল্লাহ আকবর, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। এভাবে দেশপ্রেমিক সৈনিক ও আধিপত্যবাদ বিরোধী জনতার সম্মিলিত জাগরণের মধ্যে চূড়ান্ত পরাভব ঘটে রুশ ভারত অক্ষ শক্তির চিহ্নিত এজেন্ট খালেদ মোশারফ চক্রের। অবসান ঘটে আওয়ামী বাকশালী দুঃশাসনের, মুছে যায় রুশ-ভারত অপশক্তির আধিপত্যের শেষ চিহ্নটুকু। অপসৃত হয় শ্বাসরুদ্ধকর বাকশালী ব্যবস্থা পূণর্বহালের ষড়যন্ত্রকারীরা। ৭ নভেম্বরের প্রভাতে সিপাহী-জনতার সম্মিলিত বিপ্লবের মধ্যদিয়ে বিজয় সূচিত হয় শুভ শক্তির, উন্মোচিত হয় গণতন্ত্রের অতি উজ্জ্বল সদর দরজা। 

পর্যালোচনা 
বিগত সাড়ে তিন দশকে আওয়ামী-বাকশালী মহল নভেম্বর বিপ্লবকে নানাভাবে অপব্যাখ্যা করেছে। এই ঘটনার দায় দায়িত্ব ভিন্নতর মহল, দলশ্রেণী গোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। সাতই নভেম্বরকে বিতর্কিত ও কলুষিত করার নানান অপচেষ্টা চালিয়েছে। জাতির এই মহান অর্জনকে বিকৃতভাবে চিত্রিত করার অপপ্রয়াস পেয়েছে। এমনকি নভেম্বর বিপ্লবকে তারা মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস বলেও প্রচার করে থাকে। এভাবে নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের অসত্য ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মহান নভেম্বর বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে ছিল একদিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় আওয়ামীলীগের চূড়ান্ত ব্যর্থতা ও বেপরোয়া লুণ্ঠন দুর্নীতির ইতিবৃত্ত। অন্যদিকে রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি, মারামারি-ত্রিমুখি সংঘাত সংঘর্ষ। যেমন (১) শেখ মুজিবকে উৎখাত করে খন্দকার মোশতাক, (মুজিবের আজীবন ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী)- রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রন নিজ হাতে নেন। অবিলম্বে তার সাথে যোগদেন আওয়ামীলীগের বহু সংখ্যক শীর্ষ নেতাকর্মী মন্ত্রী এমপি প্রমূখ যাদের অনেকেই আবার আজো অত্যন্ত মূখর ও তৎপর। (২) সেনাবাহিনীর একাংশকে সামনে রেখে জেনারেল খালেদ মোশাররফকে শিখ-ি বানিয়ে লীগের আরেকটি অংশ ক্ষমতা পূনর্দখলের (বাকশাল প্রতিষ্ঠার) চেষ্টায় লিপ্ত হয়। (৩) অবসর প্রাপ্ত কর্ণেল তাহের ও ইনু প্রমূখ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা গোষ্ঠীটির (যারা মূলতঃ আদি আওয়ামীলীগেরই একটি বিদ্রোহী শাখা, কেউ কেউ বিটিমও বলেন) ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করে। প্রথমোক্ত দুই গোষ্ঠী/চক্রের দ্বন্দ্ব সংঘাতের ফাঁকে ক্ষমতা হাতানোর চেষ্টা করে, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখে তৃতীয় চক্রটি। এ ত্রিমুখি চক্রান্তের টানাপড়েনে নৈরাজ্য হানাহানি বিশৃংখলায় এক প্রচ- ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয়, এতে নানামুখি ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে বেঘোরে প্রাণ হারায় তিনপক্ষেরই অনেক খেলোয়াড়, কেউ বা করেন দেশ ত্যাগ। এরা সকলেই কথিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। অন্য কোন দেশজ পক্ষ এতে জড়িত ছিল না, দায়িও নয়। তবে পর্দার অন্তরালে স্বার্থান্বেষী বিদেশী চক্র সক্রিয় ছিল বলে কথিত আছে। শেখ মুজিবের খুব কাছের সামরিক-বেসামরিক লোকদের ক্ষমতার লোভ পারস্পারিক বিদ্বেষ প্রতিশোধ প্রতিহিংসার রাজনীতি অবশেষে সৃষ্টি করেছিল ৭ই নভেম্বর। লীগাররা ক্ষমতা কুক্ষিগত কিংবা চিরস্থায়ী করতে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। ফলে মাত্র তিন বছরে তারা দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের দুঃশাসনের ফলে জাতি নেতৃত্বহীন দিশেহারা অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে সংঘঠিত হয়েছিল মহান নভেম্বর বিপ্লব। আর তার মধ্য দিয়ে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। অনেকেই জিয়াকে সামরিক শাসনের সূচনাকারী হিসেবেও অপবাদ দিয়ে থাকেন। সামরিক জান্তা হিসেবে কটাক্ষ করেন। আসলে যারা এসব বলেন তারা সত্যের অপলাপকারী-জ্ঞানপাপী। কেননা, এরা ইতিহাসকে অস্বীকার করেন। সত্যকে পাশ কাটিয়ে যান বা আড়াল করতে চান। 
জিয়া কখনো সামরিক আইন জারী করেন নাই। চক্রান্ত করে রাষ্ট্র ক্ষমতাও দখল করেন নাই। তাঁর পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন চক্রগুলোই সামরিক শাসন জারী করে রেখেছিল। কেননা মাত্র ১৩৩৫ দিনের আওয়ামী বাকশালী দুঃশাসন দেশে এক বিশাল রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছিল। আবার তারাই দৃশ্যপটের রদবদল ঘটিয়ে সামরিক শাসন প্রবর্তন করেছিল। কিংবা সামরিক ছত্রছায়ায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছিল। এসব ঘটনা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে এক দিকে আওয়ামী বাকশালীদের অপরিণামদর্শীতা ক্ষমতার লোভ ও অপশাসনের বহির্প্রকাশ ঘটেছে, অন্য দিকে এক বিপুল রাজনৈতিক প্রশাসনিক শুণ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। রাষ্ট্রযন্ত্র স্থবির হয়ে পড়ার উপত্রুম হয়। কোন সুস্পষ্ট সরকার নাই, দল নাই, গণমাধ্যমও ধ্বংস প্রায়, সেনাবাহিনী বিশৃংখল, রাষ্ট্র বিপন্ন। এহেনও ভয়ংকর শুণ্যতা পুরণের জন্য তখন সর্বাধিনায়ক জেনারেল জিয়ার কোন বিকল্প ছিল না। অভিভাবকহীন জাতি, নেতৃত্বহীন রাষ্ট্রটি অস্তিত্ব সংকটে ও বিদেশী আগ্রাসনের মুখেও পড়তে পারতো। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতির দাবী মিটাতেই জিয়াকে এগিয়ে আসতে হয়েছে, রাষ্ট্রকে নিরাপদ, জাতিকে সুসংহত ও প্রশাসনে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে, সেনাবাহিনীতে কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্টায় একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিকের দরকার হয়ে পড়েছিল। এইসব ঘটনা প্রবাহ সৈনিক জিয়াকে নিয়ে আছে রাজনৈতিক মঞ্চের পুরোভাগে। হতবিহ্বল জাতিও তাকে পরম আস্থায় গ্রহণ করে। ইতিবাচক সামাজিক রুপান্তর ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিণির্মাণের কর্মকা-ের নেতৃত্ব দিতে জিয়াই এগিয়ে আসেন। কাজেই জেনারেল জিয়া চক্রান্ত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন নাই। কোন সামরিক শাসনও প্রর্বতন করেন নাই। বরং গণতন্ত্র দ্রুত প্রতিষ্ঠার তথা বেসামরিকীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই হচ্ছে ইতিহাসের বাস্তবতা।

শেষ কথা
জেনারেল খালেদ মোশাররফ গং ছিলেন আধিপত্যবাদীদের হাতের কুঠার, কর্ণেল তাহের ও তার ‘সৈনিক সংস্থা’ ছিল ক্ষমতালিপ্সু একটি দুষ্টচক্র, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে তছনছ করার অভিপ্রায় ছিল এদের সকলের। কিন্তু দেশপ্রেমিক সামরিক বেসামরিক বিপ্লবীগণ চক্রান্তকারীদের সব নষ্ট অভিলাষকে ব্যর্থ করে দেয়। তাই এ বিপ্লব ছিল নয়া সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে এক বিশাল বিজয়। সে দিনের সিপাহী জনতার এ অর্জন ছিল আধিপত্যবাদের চক্রান্তকে প্রতিহত করে দেশের সার্বভৌমত্বকে অক্ষুন্ন রাখার আকাঙ্খার বিজয়। সে দিন যদি নয়া আধিপত্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদকে রুখে দিতে না পারা যেত তবে এদেশের ইতিহাস বদলে যেত, ভিন্নতর কাঠামোয় হয়তো এই রাষ্ট্র/জাতিকে পরিচয় দিতে হত। 
মহান নভেম্বর বিপ্লবের মধ্যদিয়ে এই জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি সাহস পায়। এক নতুন দিগন্ত অভিমুখে যাত্রা শুরু করে জাতি। রাজনৈতিক কূটনৈতিক সামরিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক সব দিক থেকে জাতির আত্ম-উদ্বোধনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আত্ম-প্রতিষ্ঠার এক নব লগ্ন সমুপস্থিত হয়। এই বিপ্লবকে অক্ষুণ্ন রাখা সকল দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব।

ফেসবুকে অগ্নিগিরি

সংবাদপত্র

পত্রিকার কলামসমূহ

বাংলা সাময়িকী

রবীন্দ্র রচনাবলী

নজরুল রচনাবলী

টেলিভিশন

জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সমূহ

অনলাইন রেডিও