একান্ত আলাপচারিতায় কবি আল মাহমুদ
(আল মাহমুদ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর প্রকৃত নাম মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ। তিনি একধারে একজন কবি, উপন্যাসিক, গল্পকার এবং সম্পাদক। ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর পরিচালক। অসংখ্য কালজয়ী লেখার স্রষ্টা তিনি। গত ৪ মে, ২০১৬ সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় হাজির হলাম আমরা। উদ্দেশ্য- সাক্ষাৎকার গ্রহণ। গিয়েই বুঝতে পারলাম বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন তিনি। কথাও বললেন চমৎকারভাবে। ছড়া, কবিতা, স্মৃতিচারণ আর গানে গানে কেটে গেল প্রায় দু’ঘন্টা। দেশ-কাল এবং শিল্প-সাহিত্যের অনেক বিষয় নিয়েই কথা বললেন খোলাখুলিভাবে। জমজমাট সে সন্ধ্যার সাক্ষাৎকারটি এখানেই...)
:বর্তমানে আপনি কী করছেন?
-আমিতো বর্তমানে বেশ কয়েক বছর ধরে কিছু করছি না। নাতি নাতনী পড়ে শোনায় আমি শুনি।
:লেখালেখি কিভাবে করেন?
-যখন লেখার ইচ্ছা হয় তখন নাতি নাতনীকে বলি ওরা লেখে। এছাড়া তো কোন পথ নেই।
:কিভাবে লেখেন?
-আমি বলি তারা ডিকটেশন নিয়ে লেখে।
:কী ধরণের লেখা লেখেন?
-গল্পও লেখি, কবিতাও লেখি।
:এভাবে কি আপনার বই বের হয়েছে?
-হ্যাঁ
:কয়টা বই বের হয়েছে?
-বেশি না, একটা বোধ হয় বেরিয়েছে।
:এবারের বইমেলায় কী বই আসছে আপনার?
-বই আসছে, তবে নাম মনে নেই।
:বর্তমান তরুণ প্রজন্মের জন্য আপনার কী বলার আছে সাহিত্যের ব্যাপারে?
-পড়তে বলবো।
:কী ধরণের পড়া?
-পড়ার কি জাত-বিচার আছে নাকি? যা খুশি তাই, যা মন চায় তাই। যা পড়তে ভালো লাগে তাই পড়বে।
:কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম যে পড়াবিমুখ, এর কী হবে?
-আমি মনে করি পড়তে হবে, পড়ার কোন বিকল্প নেই।
:বর্তমানে যারা সৃজনশীল লেখক, বিশেষ করে বাংলাদেশে যারা আদর্শিক সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করেন, তারা কিছুটা বর্তমান শাসকগোষ্ঠী কর্র্তৃক বেকায়দায় রয়েছে, তারা বিভিন্নভাবে এক ধরণের নির্যাতিত।
-কী রকম বলো?
:এই ধরুণ, জেল-জরিমানা, হুলিয়া ইত্যাদি চলছে আরকি। আপনার কি মনে হয়, এই সংকটের উত্তোরণ ঘটবে?
-আমিতো ভবিষ্যৎ বক্তা নই। এটাতো আমি বলতে পারবো না যে, সহসা হবে কিনা। তবে এর উত্তোরণ ঘটবে, এভাবে চলতে পারেনা।
:যারা এই নির্যাতন সহ্য করছে তাদের প্রতি আপনার পক্ষ থেকে বার্তা কী?
-ধৈর্য্য ধরা, আল্লাহর কাছে মিনতি করা, প্রার্থনা করা।
:বিভিন্ন সময়ে এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে, তাই না? ইতিহাস তো তাই বলে।
-ইতিহাস তাই বলে। অত্যাচারকারী আর নিপীড়িতদের মধ্যে একটা পার্থক্য থাকে, একটা সময় পর নিপীড়িতরা বিজয়ী হয়, উঠে দাঁড়ায়।
:আমরা আশাবাদী।
-আমিতো আশাবাদী। আমিতো বিশ্বাসী মানুষ।
:আপনি যে বিশ্বাসের কথা বলেছেন, বিশ্বাসের বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন, বিশ্বাসী মানুষদের সাথে চরাফেরা করেছেন, এই বিষয়টাকেও অনেকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখে।
-কী রকম?
:তারা বলে যে আপনি গোড়া হয়েছেন, মৌলবাদী হয়েছেন, একটা ঘরনায় চলে গিয়েছেন- এই সমালোচনার ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
-আমি এর প্রতিবাদ করতে চাই না।
:আপনি সমালোচকদের কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
-আমার সমালোচকই তো বেশি, খুব আজেবাজে সমালোচনা করে। কখনো শুনে হাসি, কখনো রাগ হয়, মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
:একটা জীবনে আপনি অনেক লেখা লিখেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন, তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
-আমি নিজে এর সাথে যুক্ত ছিলাম। লিপ্তও ছিলাম। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে জড়িত ছিলাম। তাদের সাথে কাজ করেছি। নানানভাবে আমি লিপ্ত ছিলাম।
:মানে আপনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?
-আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম এটা বলা বাহুল্য, বলার কোন দরকার নেই। মানে আমি লিপ্ত ছিলাম, যুক্তও ছিলাম। এবং আমার একটা স্বাদ আছে জীবনে। আমি একটা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লিখবো। এবং এটা খুব তাড়াতাড়ি আমি শুরু করবো। এ বইটাতে ঐসব কথাবার্তা আসবে। আমি এসব কখনো বলিনি, এসব বলাকে আমি অহংকার মনে করি। আর অহংকার হওয়ার ভয়েই আমি কখনো বলিনি।
:আপনারতো দুইটা আত্মজীবনী আছে, একটা- যেভাবে বেড়ে উঠি, আরেকটা- বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ।
-এগুলো খ-িত। পুরো জীবনকে নিয়ে লিখতে চাই। আল্লাহ আমাকে হায়াত দিয়েছেন, আমি হায়াতকে উদযাপন করছি।
:কখনো আপনার মধ্যে কি মৃত্যুর চিন্তা আসে না? মৃত্যুকে কিভাবে দেখেন আপনি?
-হ্যাঁ, আসে। এটা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখি। আমার বয়স হয়েছে, আমার মৃত্যু হবেই, কোন একদিন অসুখে বা বিসুখে। আমার বয়স ৮০ বছর হয়ে গেছে, মৃত্যুর চিন্তাতো করিই।
:মৃত্যুকে কি ভয় পান?
-নাহ, খুব স্বাভাবিকই মনে করি।
:মৃত্যু পরবর্তী জিন্দেগী সম্পর্কে আপনার চিন্তা কী?
-আমি বিশ্বাস করি।
:আপনার দুইটা উপন্যাস আছে, একটা- কাবিলের বোন, আরেকটা- উপমহাদেশ। এদু’টা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস। প্রশ্ন হচ্ছে- এ দু’টা কি কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাকি কাল্পনিক?
-দুটোই বাস্তবতা এবং কল্পনা মিশ্রিত। আমিতো মনে করি বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের ওপর এ দু’টি বই-ই আছে।
:অন্য যারা মুক্তিযুদ্ধের ওপর বই লিখেছে?
-কারা লিখেছে? নাম বলো।
:আপনার একজন সহকর্মী লিখেছিলেন ‘বন্দি শিবির থেকে’।
-আমার বন্ধু কবি শামসুর রহমান লিখেছিলেন। তো ঐটাতে কী আছে বলো?
:বন্দি শিবিরে থাকার যে স্মৃতি বা অনুভূতি, তা লেখা আছে।
-আমি পরিচিত ছিলাম না এ বই পড়ে।
:কারণ কী?
-যেটা আমি জানি উত্তমরূপে, সেটা তিনি না জেনেই লিখেছেন।
:মানে বলতে চাচ্ছেন- তিনি আসলে কখনো বন্দি শিবিরে ছিলেন না, তবুও লিখেছেন ‘বন্দি শিবির থেকে’। আর আপনি মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে থেকেই লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস। পার্থক্য এটাই।
-আমি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখবো বলে লিখিনি। বিষয়টা এরকম ছিলো যে, ঐ জিনিসই ছিল মুক্তিযুদ্ধ।
:কিন্তু বর্তমান সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছে, মুক্তিযুদ্ধকে যারা ধারণ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের ওপর যারা কাজ করেছে, তারা মুক্তিযোদ্ধা না বা মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত শক্তি যেমন রাজাকার, আল বদর ইত্যাদি। এই কাতারে যারা যারা অবস্থান করছেন আল মাহমুদকেও সেই কাতারে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টা আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
-এটা তোমার বিচার। আমি কে, কোথায় ছিলাম, কী করেছি, আমার কিছু কাজ আছে সাহিত্যে- সেটা থেকে অনেক কিছু পাবে। একটা বই আছে ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’। ওরকম একটা বই বাংলা সাহিত্যে নেই।
:আপনার যে উপন্যাস কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, আগুনের মেয়ে, কবি ও কোলাহল, মরু মূষিকের উপত্যকা, যমুনাবতী, খোলস ছাড়ার সময়, সর্বশেষ উপন্যাস ওগো বনো হংসিনী আমার। এই যে কথা সাহিত্যে আপনার যে বুনট, এটা একজন কবি হিসাবে আপনি আপনার কবিত্ব শক্তি থেকে এই উপন্যাস রচনা করেছেন, না একজন ঔপন্যাসিক হিসাবে উপন্যাস রচনা করেছেন?
-আমি যখন উপন্যাস লিখি, তখন ঔপন্যাসিক হিসেবেই লিখি। আমি যে কবি এটাতো বাড়তি সুবিধা।
:আপনার কবিতা এবং উপন্যাস এই দুই শাখার মধ্যে কোনটা বেশি প্রতিষ্ঠিত বলে আপনি মনে করেন?
-আমি খুব কমই বই লিখেছি। তবে এর একটাও ব্যর্থ হয়নি।
:তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, দুটোতেই আপনার সফলতা সমান?
-হ্যাঁ, লক্ষ্য ভেদ হয়েছে।
:আপনি দুর্দান্ত ছোট গল্পকার ছিলেন। আপনার কালো নৌকা পড়লে আমরা বিমোহিত হই। পানকৌড়ির রক্ত আপনার লেখা প্রথম গল্প। এগুলো যখন পড়ি তখন এক আশ্চর্য জগতে আমরা প্রবেশ করি। তবে প্রশ্ন হলো- এখানে কবিতার প্রভাব কাজ করেছে কিনা?
-আমিতো কবি। প্রভাব তো থাকবেই।
:আপনি কবি না হলে কী হতেন?
-এটাতো বলা মুশকিল। হতে তো চেয়েছিলাম অনেক কিছুই। হতে তো পারিনি।
:ইচ্ছা কী ছিল?
-আমার অবশ্য ইচ্ছা ছিল আমি কবি হবো।
:আপনি কবি হতে চেয়েছিলেন এবং আপনি কবিই হয়েছেন। তাহলে আপনার জীবন স্বার্থক বলে আপনি মনে করেন?
-এটা ঠিক আমি বলি না। স্বার্থকও না, ব্যর্থও না, তবে অতৃপ্তি রয়েছে।
:বর্তমান সময়ের কবিতা গুলো কি আপনি পড়েন?
-পড়ি মাঝেমধ্যে।
:কী মনে হয় আপনার, কবিতা কোথায় যাচ্ছে?
-এটা তো বলা মুশকিল। আমি হলাম কবি, কবিতা আমি পড়ি। কবিতা যেখানেই ছাপা হোক, আমি পড়ি। কবিতা লিখিও আমি।
:এখন আপনার দিন কাটে কিভাবে?
-এইতো ঘরে বসে থাকি। কোথাও যাই না, চোখেও দেখি কম।
:ঘুরতে ইচ্ছা করে?
-ঘুরতে ইচ্ছা করে। একসিডেন্টের ভয়ে যাই না।
:কোথায় যেতে ইচ্ছা করে?
-এই যে ঢাকা শহরটা, কত যে প্রিয় শহর আমার! এই শহরে আমি বেরোতে পারিনা।
:নতুন কবি সাহিত্যিকদের জন্য কিছু বলেন।
-আমি পড়তে বলি। দিন রাত সমানে।
:নতুন কবি সাহিত্যিকরা তো এখন ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত।
-হ্যাঁ, যাই হোক, যে বুকই হোক, পড়তে হবে।
:আপনার কি এমন মনে হয় যে- এই বইটি পেলে আমি পড়বো?
-হ্যাঁ, মাঝে মাঝে মনে হয়।
:কোন বইটা?
-দক্ষিণা রঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাঁকুরমার ঝুলি।
:আপনি যে এখন পড়তে পারেন না এর জন্য কি আপনার আপসোস নেই?
-খুব আফসোস। বই দেখে পড়তে পারিনা এর চেয়ে আফসোস আর কী হতে পারে।
:আপনি যখন পড়তে পারতেন তখন দিনে কয় ঘন্টা ধরে বই পড়তেন?
-দিন রাত সমানেতো বইই পড়তাম। একটা কোল বালিশে ধাক্কা দিয়ে শুয়ে বই পড়তাম। কখনো কখনো রাত পার হয়ে যেত।
:আমরা আপনার সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি। আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
-ফি আমানিল্লাহ।
সাক্ষাৎকার গ্রহনে- নাজমুস সায়াদাত, ওয়াহিদ জামান ও মাহমুদ রনি