অন্যরকম স্বপ্ন ও ভালবাসা
আশরাফ উদ্দীন আহমদ
বাসটা অকস্মাৎ বিশ্রী একটা শব্দ করে দাঁড়ালো পৌরসভার প্রধান গেইটের মুখে। কয়েকজন যাত্রীর সাথে বাস থেকে নেমে ডাকঘর মোড়ের দক্ষিণ দিকের রাস্তা ধরে সোজা যেতে থাকে পরীবানু। অর্জুন গাছের মাথায় দুপুরের রোদ খেলা করছে, কয়েকটা কাক কা-কা করে ডেকে যাচ্ছে। পৌরসভার গেইটের মাথায় দুটো শালিক বসে আছে। পরীবানু এখন হাঁটছে, কাঁধে তার একটা পুটলি জাতীয় কিছু, এলোমেলো শাড়ির আঁচল বাতাসে খেলা করছে।
এক সময় ব্যানার্জীদের পুকুর পাড়ের সরু পথের পাশের ঘাসে ধপ করে বসে পড়ে। পুটলি খুলে পানবাটা বের করে। আঙুলের ডগায় চুন নিয়ে একটা পানের পিঠে ঘষে। তারপর একটু কুচো সুপারি আর বাবা জর্দ্দা মুড়িয়ে মুখের ভেতর পাচার করে দেয়। দাঁতগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে কেমন যে হয়ে গেছে। একটু হাসলেই দাঁতগলিয়ে মহাসাগর দেখা যায়। চোখ দুটো কতোকাল যাবৎ খাচে পড়ে আছে তারই বা ইতিহাস কে রাখে? মনে হয় মুখের চোয়াল ভেঙে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবে। চিবুকে কালের রেখা শুধু জানিয়ে দেয় পৃথিবীর বয়স। সরু মেঠো পথের মতো চিকন শরীরখানা মাজা ভাঙ্গা হেলে সাপের মতো কোনমতে এগিয়ে যায়। শরীরে মাংস আছে কি নেই সেটাও বোঝার উপায় নেই। মনে হয় ব্যাঙের চামড়ার মতো পরীবানুর অস্তিত্বের মধ্যে একটা পাতলা আবরণ তার শক্ত হাড়গুলোকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। কালো তেল চিটচিটে শাড়ীটা কবে কে যে দিয়েছে, তার নাম ধাম পাওয়া এখন ঐতিহাসিকদের ব্যাপার।
পুকুর পাড়ে গোল কলমী-আকন্দ-সেয়াকুল বুজটার ঝোপ-ঝাড়। তার আশেপাশে দু’চারটে ছোট-ছোট খেজুর গাছ মাথা চাড়া দিচ্ছে। সেই খেজুর গাছের ডালে কয়েকটা পাখি লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্তে। পরীবানু পান চিবুতে-চিবুতে সেদিক তাকিয়ে থাকে। চোখ তার উদাসীন। পুর্বের বাঁশ ঝাড়ের ভেতর সরু পথ ধরে সাইকেল চড়ে বিষ্টুর ছেলে ভাদু এদিকে আসে। পরীবানুকে পুকুর পাড়ে বসে থাকতে দেখে সাইকেল থেকে বাম পা-টা নামিয়ে একটু হেসে বলে কি গো মাসি এখানে--
পড়ন্ত বেলায় রোদ তখন বাঁশ ঝাড়ের পিঠে আলো-আঁধারিতে খেলছে। দূরে কোকিল ডেকে যাচ্ছে আপন খেয়ালে। পুকুর ঘাটে কয়েকজন মেয়ে লোক নাইছে। বুক উদোম করে মাঝ বয়সি মেয়েগুলো যেভাবে নাইছে তাতে পরীবানুর একটু লজ্জা লাগে। চোখে মোটা মুটি দেখতে পায় বলেই, দূরের দিকে তাকিয়ে পেছনের স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে হাতড়ে হাসে কখনো। তার সময়ে সে-কি দিনই না ছিলো। কোথায় গেলো সে সব কাল। বয়সের ভারে সব যেন নুয়ে পড়ে আছে মহাকালের কাছে। ভাদু আবার পরীবানুকে বলে, ও মাসী এখানে বসে কি ভাবছো গো----- এবার ভাদুর কথা পরীবানুর কানে যায়। তার দিকে চোখ ফিরিয়ে মলিন হাসি ছড়িয়ে বলে কে বাছা তুই, বিষ্টুর ছেলে ভা-দু----- ভাদু এবার এক গাল হেসে উঠলো। হা- হা গো, মাসি, ভাদু আমি তা ধরেছো তো --- যাক তা হাতে পুটলি নিয়ে কোথায়? পরীবানু একটা নিঃশ্বাস ফেলে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে উঠলো, আর কোথায় যাবো, আমঘাটা গিয়েছিলাম রাধী ছেলে জন্ম দিয়েই কি যেন ওই অসুখে মরে গেলো রে ------ ভাদু একটু হোচট খায়। কি হয়েছিলো। রাধীর বর, ডাক্তার কবিরাজ দেখায়নি। অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে পরীবানু বললো, হা ডাক্তার। ডাক্তার ব্যাটা বলেছিলো গায়ে সুঁচ ফোটাবে, সেই ভয়েই মেয়েটা ভাদু এবার হা-হা করে উঠে। আহা তাই বলে কি না মেয়েটাকে নিজ হাতে মারলে মাসী। গায়ে ইঞ্জেকশন দিলে কি এমন ক্ষতি হতো? তা ওর বাচ্চা কোথায় হয়েছিলো---- পরীবানুু ভ্যাবাচ্যাকা খায় একটু। কি বলতে হবে এখন, বুঝে পায়না। একটু সময় নিয়ে বললো, নিজের বাড়িতেই হয়। ওর শ্বাশুড়ী আবার খুব ভালো ধাঁই কি-না। আমিও ছিলাম তবে হাত দেয়নি ---- হাত শরীর কাঁপে। কাছে পিঠের জিনিস চোখেও দেখি না খুব একটা--- পরীবানুর কথা শেষ হতেই ভাদু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ভালোই করেছো মাসী-----দুনিয়া যেখানে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে তোমরা ধাঁইগুলো গরুর গলায় দড়ি দিয়ে দুনিয়াটাকে পেছনের দিকে নিয়ে বেঁধে রাখতে চাও। কি যে তোমাদের ধ্যান-ধারণা---- সনাতনি জ্ঞান এখন বিজ্ঞানের এই যুগে অচল মাসী---- পরীবানু মনে মনে ভাদুর কথা শুনে রেগে যায়। কিন্তু এ সময়ে কিছুই বলতে চায় না। বাতাসের ধাক্কায় নিমগাছের পাতাগুলো ঝিরঝিরিয়ে কাঁপে।
এক সময় ভাদু পাডেলে পা তুলে সাইকেল চালিয়ে চলে যায়। খুব কাছ থেকে মাইকের গান ভেসে আসে। সাজু মুন্সীর মেয়ে ময়নার বিয়ের গায়ে হলুদ। ছেলে কালনার জামসেদপুরের। কাপড়ের দোকান আছে। খয়েরের বাবা আগে ফুটে ব্যবসা করে কিছু টাকা হাতিয়েছিলো। সেই সুত্র ধরেই খয়ের আজ দোকান নিয়ে বিশাল সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেদারসে ব্যবসা করছে। তাছাড়া জামসেদপুরে খয়ের ভিডিও হল দিয়েছে, বছর খানিক ধরে। সকাল থেকে রাত্রি অবধি বাংলাদেশ-বোম্বে, কলিকাতা-পাকিস্তানের সুপারহিট ছবিগুলো চলে। কোনো কোনো দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী কখনো কখনো কেনিয়া-কোরিয়া-চীন-সুইডেন-ডেনমার্কের ব্লুু-ফ্লিম চালানো হয়। সে চার্জ অনেক। বিশেষ দর্শকরা অবগত আছে । পরীবানু অনেক আগে থেকেই জানে কালনার ময়েজ উদ্দীনের বড় ছেলে খয়েরের সঙ্গে ময়নার বিয়ের খবর। খয়ের হওয়ার সময় পরীবানুই যে ওর মায়ের কাছে ছিলো। খয়েরের জন্ম নাড়ি কাটে সে। শুধু খয়েরেই নয়, ময়েজ উদ্দীনে বৌয়ের তিন ছেলে পাঁচ মেয়ে সব ক’টা পরীবানুর হাতেই হয়। শেষেরটা হওয়ার সময় খয়েরের মায়ের জ্ঞান আর ফিরলো না। তারপর চিরকালের জন্যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। সেই হলো পরীবানুর হাতে প্রথম মরা। আর সেই জের চলছে পরীবানু উপর আজ অবধি। মুখ বন্ধ রেখে সবই সহ্য করে। এছাড়া তার কি বা উপায় আছে। ময়নাও তো তারই হাত দিয়েই পৃথিবীর আলোতে এসেছে। ওর সব ক’টা ভাই-বোনও পরীবানুর হাত ধরে জীবন পেয়েছে। বিষ্টুর বউ যতদিন বেঁচে ছিলো বড় ভালোবাসতো পরীবানুকে।
পরীবানুর মনটা উদাস হয়ে যায়। কোথায় গেলো সেসব দিনগুলো। দিনকাল কিভাবে পাল্টে গেলো বোঝেনা পরীবানু। আজকাল ছেলেছোকরা গুলো কি সব বোঝে? পুরুষ ডাক্তারের হাতে ছি.ছি এ-কি দিনকাল--- মানুষের হায়া সরম সব কি তাহলে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে। এ-কোন্ কাল এসে পড়লো। মনে মনে পরীবানু অনেকদিন কথাগুলো ভেবেছে একা-একা। পরীবানু নিজের মনেই বকতে থাকে। দূরে তাকিয়ে দেখে আকাশটাকে উদাসীন চোখে। শান্তিপুরের আকাশ আর বাতাস তার কাছে কতো পরিচিত। কয়েকদিনের ব্যবধানে মনে হচ্ছে পরীবানু কতোকাল শান্তিপুর থেকে দূরে সরে ছিলো। এখানে এই মাটির বুকে শেষ জীবন কাটিয়ে দেবে আর যতদিন বাঁচে। কোথাও যাবে না কোনোদিন। কোথাও গিয়ে কি নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারবে? পারবে না। আর পারবে না বলেই, সেবার হিন্দু-মুসলমানের জাতিগত ধুয়া তুলে দেশটা ভাগ হলো। মুসলমানদের একটা দেশ হলো, স্বাধীন দেশ। কিন্তু পরীবানু নিজেকে শুধুমাত্র মুসলমান পরিচয় দিয়ে হিন্দু দেশ ছেড়ে মুসলমান দেশে ফিরে যায়নি। কেনো যাবে? কোথায় যাবে? পরিচিত আকাশ-বাতাস, মাটি-দেশ, মানুষ, নদী, গাছ-গাছালি ছেড়ে কেনো যাবে? নির্বাসন কি সবার জন্যে? পরীবানুর স্বামীও যায়নি। অনেক চিন্তা শেষে হিন্দুদেশেই থেকে যায়। নতুন দেশ-নতুন পরিবেশ নতুন মানুষদের কাছে যেতে মন সাঁই দেয়নি। মনে মনে ভেবেছে শুধু কি ধর্মের জন্যে মানুষ মানুষের শত্রু হয়?
পরীবানু এখন আর নিজের কপালের দোষ দেয়না। মনটাকে শক্ত করে বেঁধেছে। মনে মনে শুধু বলে আল্লাহ যা ভালো চেয়েছেন, তাই করেছেন, এছাড়া তার বা কতোটুকু ক্ষমতা। এদেশের মাটি আর মানুষগুলো তাকে আজও ভালবাসে বলেই যে সে বেঁচে আছে। পৃথিবীর আলো-হাওয়া পানি পেয়ে বৃক্ষ যেমন বাঁচে, তেমনি পরীবানু বেঁচে আছে। আর সেজন্য কখনো কখনো বৃক্ষের সাথে কথা বলে। এই গাছগুলোতে যেন তার সাথে অতি আত্মীয় হয়ে গল্প করে। প্রাণ খুলে হাসে।
পরীবানুর বিয়ে হয়েছিল এক বুনিয়াদী ঘরে। স্বামী বেচারা তাকে ভালোবাসতো প্রচন্ড। লংকাকান্ড বাধিয়ে ফেলতো চোখের এতটুকু আড়াল হলেই। সেই স্বামী গোবেচারা একে একে চারটে সন্তান দিয়েছিলো তাকে। কিন্তু পরীবানু একটাকেও বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। জন্মের পনেরো কুড়ি দিনের মাথায় কোল ছেড়ে চলে যায়। অনেক তাবিজ কবজ করেছিলো ওর স্বামী-শ্বাশুড়ী মা। কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু হয়নি। চারটে সন্তানই তাকে ফাঁকি দেয়। লোকে বলতো কোলের দোষ----- কেউ বা বলতো, বুকের দুধে বিষ----- অনেকে আবার একটু আনা বাড়িয়ে বলেছে, পরীবানু রাক্ষুসী, ওই সন্তানদের খায়---- পরীবানু ওদের কথা শুনে শুধুই কেঁদেছে গুমরে গুমরে। প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে তাকিয়ে দেখেছে বোবা চোখে। ওর চোখের ভাষা কেউ বুঝেনি কোনদিন। বুঝেছে পুকুরের মাঝখানে পোতা বাঁশের ওপর বসা মাছরাঙা পাখিটি। অথবা বুঝেছে আম-জাম, নারকেল-নিম, তাল-খেজুর গাছ আর বাঁশঝাড়ের পাতায় পাতায় ছড়ানো রূপালী রোদটুকু। একদিন বেচারীর স্বামী মাঠ থেকে কাজ করে এসে মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে। তারপর দুদিন কালা জ্বরে অজ্ঞান থেকে তিন দিনের দিন চোখ বুজলো চিরকালের জন্যে। পরীবানুকে কাফনের মতো শুভ্র সাদা শাড়ি পরিয়ে লোকটি ধেই ধেই করে চলে গেলো সীমাহীন আকাশের কাছাকাছি। কি এক অভিমানে? পরীবানু কিছুুই জানে না। শুধু আকাশের কাছে এখন প্রশ্ন করে। অনেক অনেক প্রশ্ন।
রাধি তার বোনের মেয়ে। সেই ছোট বয়সেই ফুলিয়া থেকে নিয়ে আসে। রাধির মা যেদিন হঠাৎ করে মরে যায়, কি এক পচানো রোগে। কবরাজ বলেছিলো, বাতাসের দোষ----- হেকিম বলোছিলো, রোগটা বড় মারাত্নক হে - কিন্তু খরচার কারণে রাধির বাপ আর চিকিৎসা করালো না। শেষে ওই গাছ-গাছড়া তাবিজ কবজ করেও কিছুই হবে না যখন ---- সেই রাধিকে কসাই বাপ রাখতে চাইলো না। মুখের উপর বলেই দিলো, এই আতুরে বাচ্চা নিয়ে কি আমি আমার জীবন যৌবন মাটি করবো----- পরীবানু নিজ চোখেই দেখলো একজন পাষন্ডকে। মনে মনে ভাবলো এও বাপ একজন।
রাধি তার বোনের মেয়ে। সেই ছোট বয়সেই ফুলিয়া থেকে নিয়ে আসে। রাধির মা যেদিন হঠাৎ করে মরে যায়, কি এক পচানো রোগে। কবরাজ বলেছিলো, বাতাসের দোষ----- হেকিম বলোছিলো, রোগটা বড় মারাত্নক হে - কিন্তু খরচার কারণে রাধির বাপ আর চিকিৎসা করালো না। শেষে ওই গাছ-গাছড়া তাবিজ কবজ করেও কিছুই হবে না যখন ---- সেই রাধিকে কসাই বাপ রাখতে চাইলো না। মুখের উপর বলেই দিলো, এই আতুরে বাচ্চা নিয়ে কি আমি আমার জীবন যৌবন মাটি করবো----- পরীবানু নিজ চোখেই দেখলো একজন পাষন্ডকে। মনে মনে ভাবলো এও বাপ একজন।
সন্ধ্যার মুখোমুখি এখন। বাড়ির লাউ মাচার কাছে দাঁড়িয়ে পরীবানু আকাশ দেখে। আকাশের সাতরঙটা পরপর ফুটে উঠে এবং তা সন্ধ্যে অবধি লেগে থাকে আকাশের বুকে। পরীবানুর আজ কেউ নেই পৃথিবীতে। স্বামী-সন্তান-রাধী সবাই তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। কি নিষ্ঠুর পৃথিবী। এতবড় এই পৃথিবী কিন্তু পরীবানুর আপন কে আছে? লাউ মাচায় ঝুলে আছে কয়েকটা লাউ। গতবারের তুলনায় এবার লাউ বেশি এসেছে গাছে। পাশের বাড়ির জুলেখার মাকে দায়িত্ব দিয়ে রাধীকে দেখতে গিয়েছিল। পাড়ার হা হাভাতে মেয়েরা লাউ কি লাউয়ের কচি পাতাগুলোকেও নিঃশেষ করে ফেলেছে। কুয়োর কাছের পেয়ারা গাছের নীচে কয়েকটা মুরগী ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় মোরগটা রাধীকে দেবে বলে সেবার কিনেছিলো। কিন্তু একবার এসে রাধী দেখেই বলেছিলো থাক্ না মাসী, তোমার তো সব মুরগী ----- মোরগটা এখানে বেশী আনন্দে আছে। রাধীর কথা মনে হতেই পরীবানুর চোখ পানিতে ভরে যায়। শান্তিপুরের আকাশেও মেঘ আছে, অকস্মাৎ কেঁদে ফেলবে কোন সময় বোঝা মুশকিল। বাতাস একটু একটু বেশ জানান দিচ্ছে গায়ে। কুলগাছের পাতারা দুুলছে। কলা গাছের ছেঁড়া ছেঁড়া পাতাগুলো শিরশির করে বাতাসের সঙ্গে কথা বলছে যেন বা। দুরে এক কাক ডাকছে থেকে থেকে। হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর পাড়ার নজির শেখের মেজো ছেলে ফরিদ শেখ পরীবানুর বাড়ির ঝাপ ঠেলে উঠোনের চৌহাদ্দিতে দাঁড়ালো। বাঁশের ঝাড়ের কচি বাশ পাতার মতো ওর দুটো ঠোট কাপছে। পরীবানু জানে ফরিদের বউ রাবেয়ার বাচ্চা হবে। বেশ ক’দিন পরীবানু গিয়ে রাবেয়ার তলপেট মালিশ করে দিয়ে এসেছিলো এবং বাচ্চা ভালো ভাবে আছে জানিয়েছে পরীবানু। এও অবশেষে বলেছে, সে এ কাজ করতে পারবে না। চোখে ভালো মতো না দেখতে পেলে এ কাজ করা উচিত না। এমন কি পরীবানু থানার হাসপাতালে ভর্তির কথাও বলেছিলো। ফরিদের আগমনে বুঝে যায় পরীবানু, কোনো বিপদ হয়েছে রাবেয়ার। আত্মচিৎকার করে ফরিদ বলে মাসী সর্বনাশ হয়ে গেছে গো----। পরীবানু হাহাকার করে বললো কি সর্বনাশ হলো বাবা----- হাঁপাতে হাঁপাতে ফরিদ বলে উঠলো, রাবেয়া চিৎ হয়ে পড়ে গেছে মাথা ঘুরে---- কি ভাবে হারামজাদী পড়লো, আহা রে ওর তো এমাসেই হওয়ার ----- কাঁদো কাঁদো করে ফরিদ বলে ঘরের দাওয়া থেকে নামতে গিয়ে কান্ডটা হয়ে গেলো, রক্তের বন্যা ঝরছে মাসী, মনে হয় রাবেয়া ----- মাসি তুমি চলো, একটু দেখো।
রাত্রের নিশাচর জোনাকিরা এখন বাসর সাজিয়ে বসেছে। আম গাছের মাথায় ওদের আসর। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাছের মানুষকেও দেখার উপায় নেই। পাতার মর্মর শব্দ বাতাসে। কি একটা পতঙ্গ থেকে থেকে ডেকে যাচ্ছে। পরীবানু কান খাড়া করে কিছুক্ষণ শুনে একটা নিঃশ্বাসে ফেলে বিনয়ী কন্ঠে বললো না-না বাবা আমি পারবো না, তুই ডাক্তার দেখা। তাছাড়া আমি চোখে আর তেমন দেখতে পাই না। তুই----- ফরিদ এবার আরো অনুরোধের সুরে বললো কে-কি বললো তা বিশ্বাস করিনা। জন্ম মৃত্যু সবই তো আল্লাহর হাত। কেউ কি ইচ্ছে করে মারে---- চলো মাসী, তোমার পায়ে পড়ি, তাছাড়া করিমন খালা, নাছিমুন চাচী তো আছে--- তোমাকে সাহায্য করবে। তোমার পাকা হাত----
রাত্রের নিশাচর জোনাকিরা এখন বাসর সাজিয়ে বসেছে। আম গাছের মাথায় ওদের আসর। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাছের মানুষকেও দেখার উপায় নেই। পাতার মর্মর শব্দ বাতাসে। কি একটা পতঙ্গ থেকে থেকে ডেকে যাচ্ছে। পরীবানু কান খাড়া করে কিছুক্ষণ শুনে একটা নিঃশ্বাসে ফেলে বিনয়ী কন্ঠে বললো না-না বাবা আমি পারবো না, তুই ডাক্তার দেখা। তাছাড়া আমি চোখে আর তেমন দেখতে পাই না। তুই----- ফরিদ এবার আরো অনুরোধের সুরে বললো কে-কি বললো তা বিশ্বাস করিনা। জন্ম মৃত্যু সবই তো আল্লাহর হাত। কেউ কি ইচ্ছে করে মারে---- চলো মাসী, তোমার পায়ে পড়ি, তাছাড়া করিমন খালা, নাছিমুন চাচী তো আছে--- তোমাকে সাহায্য করবে। তোমার পাকা হাত----
মাঝ প্রহরেই রাবেয়া একটা ফুটফুটে চাঁদের থালার মতো ছেলে বিয়োলো। পরীবানু ফোকলা দাঁতে হাসে। চারদিকে আলো যেন ঝলসে পড়ছে। কোথায় ছিলো এত আলো? রাত্রের কালো অন্ধাকর ক্রমে ক্রমে কেটে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই এবাড়িটা ভুলে যায় সমস্ত কষ্ট যন্ত্রণা। ওর চোখে এখন ভালোবাসার সীমাহীন হিল্লোল। রাবেয়াকে ঘিরে আজ এবাড়িতে বড় আনন্দ উৎসব বসেছে। শেষ প্রহরে রাবিয়ার জ্ঞান ফিরে। তার পাশে শুয়ে আছে এক রাজপুত্র। এ রাজপুত্রকে আজ থেকে সে প্রাণ ভরে আদর করবে। ভালোবাসায় ভালোবাসায় ভরিয়া দেবে রাজপুত্রকে। পরীবানুর চোখে একসময় অশ্রু জমে। তার চোখের ভাষা কেউ বোঝে না। রাবেয়ার ঠোটের পাশ দিয়ে একটু হাসি চলকে যায়। সদ্য ফোটা লাল গোলাপের মতো কচি শিশুর ঠোঁট দুটো রক্তিমাভা ছড়ালো। আর চোখ দুটো যেন শেষ প্রহরের তারকা। এখন সে ঘুমোচ্ছে। রাবিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। সীমাহীন আনন্দ আর সোহাগ বুক জুড়ে তার। অনেক সাধনায় যে বস্তু পাওয়া যায়, তার মুল্য অনেক অনেক বেশি। প্রথম প্রসুতির হাসিটুকু দেখে আর দশজন ধাই এর মতো পরীবানুর মনটা কি এক আনন্দ আবেশে জড়িয়ে যায়। একসময় রাধীর কথা মনে পড়ে তার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু পারে না কিছুতেই। কান্নাও যেন বোবা পাথর। শুধু তাকিয়ে দেখে। সমস্ত কান্নাগুলি মনে হলো হিমালয়ের বরফ হয়ে গেছে। আর কি কোন দিন গলবে না। পরীবানু কাঁদতে পারে না। এবাড়ির কোন বউয়ের এই প্রথম সন্তান। আর সেই কারণে বাড়ীটাকে সবাই যেন বা আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিচ্ছে। পরীবানুর মনটা কলার খোশার মতো এড়িয়ে যায়। হঠাৎ একসময় দমকে দমকে হাসতে থাকে। পরীবানু আর কাঁদতে পারে না হয়তোবা পারবে না কোনদিন। সে পাকা ধাঁই। চোখে তেমন দেখতে না পেলেও পাকা হাতের কারণে আজ পরীবানু সিদ্ধ লাভ করেছে। মনটা অকস্মাৎ আনন্দে ভরে ওঠে কানায় কানায়। ধাঁই প্রয়োজন তাহলে ফুরিয়ে যাইনি। মনে মনে কি এক সতন্ত্র আবেগে হারিয়ে যায়। ফরিদের মতো ছেলেরা মানিক চিনতে ভুল করেনা। সমাজে তাহলে মানিক চেনার অভাব নাই। কাঁচকে হীরা মনে করেনি তাই তার এত কদর।
এখন পরীবানুর চোখে ভেসে আসছে স্বপ্ন, হাজার হাজার স্বপ্নের লাল-নীল-গোলাপী প্রজাপতি। রাবেয়ার হাসি আর সদ্য প্রসুত শিশুর ঠোঁট দেখে পরীবানুর বুকে অন্য রকম এক আনন্দ জাগে। এ আনন্দ নতুন চর জেগে ওঠার মত মনে হল।