ভাষা ও মাতৃভাষা আন্দোলন
আলী ছায়েদ

জন্মের পরই নবজাতকের প্রথম চিৎকার দিয়েই সে মাকে বলতে চায় আমি বলতে পারি। আমি ঠিক আছি। যখনই কোন শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর তার মুখ থেকে কোন চিৎকার শুনতে না পান তখনই ডাক্তাররা চিন্তায় পড়ে যান, কোন সমস্যা আছে কি না। ফলে যে করেই হোক তাকে চিৎকার করাতেই হবে এবং নব জাতককে বলতে বাধ্য করানো হয় সে ঠিক আছে কিনা। এটিই নব জাতকের ভাষা।

খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে ভাষার সংজ্ঞা দিয়েছেন ওয়েবস্টার। তিনি বলেন, "Language was the immediate gift of God". আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা। ভাষাভাষীর দিক থেকে বিশ্বে আমাদের অবস্থান পঞ্চম। আমাদের রয়েছে নিজস্ব বর্ণ, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র মূল্যবোধ, আদর্শতাত্ত্বিক ধাঁচ, গ্লাণির স্মৃতি মুছে ক্লান্তির শেষে সুখ সমৃদ্ধি আর প্রতিষ্ঠার আলোক উজ্জ্বল শৌর্য-বীর্যের সংগ্রামী ইতিহাস; যে ইতিহাস কেবল মাত্র বাংলা ভাষাভাষীদের। এ আমাদের অমূল্য সম্পদ।

পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “আর আমি সমস্ত পয়গম্বরকে তাহাদের কাওমের (স্বজাতির) ভাষায় পয়গম্বর করিয়া পাঠাইয়াছি, যেন তাহাদের নিকট (আল্লাহর বিধানসমূহ) বর্ণনা করিতে পারেন; অনন্তর আল্লাহ্ তায়ালা যাহাকে ইচ্ছা বিপথগামী করেন; এবং যাহাকে ইচ্ছা পথ দেখান; আর তিনি প্রভাবশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা ইব্রাহিম : ৪, বঙ্গানুবাদ নুরানী কোরআন শরীফ, পৃ-৪০৭)।

পবিত্র কোরআন এর সূরা রূমের ২২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে অন্যতম আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’

এছাড়াও পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘দয়াময় আল্লাহ্, তিনিই কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন, তিনিই মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ভাব প্রকাশ করতে (কথা বলা) শিখিয়েছেন।’ (সূরা আর-রাহমান, আয়াত : ১-৪)।

আল্লাহ্ তাআলা প্রত্যেক জাতির স্বীয় মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তাদের নিজস্ব ভাষায় আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রধান চারটি আসমানি কিতাবের মধ্যে ১. হজরত মূসা আ. এর প্রতি ‘তাওরাত’ হিব্রু (ইবরানি) ভাষায়, ২. হজরত ঈসা আ. এর প্রতি ‘ইঞ্জিল’ সুরিয়ানি (সিরীয়) ভাষায়, ৩. হজরত দাউদ আ. এর প্রতি ‘যাবুর’ ইউনানি (আরামাইক) ভাষায় এবং ৪. বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা. এর প্রতি ‘আল-কোরআন’ আরবি ভাষায় নাজিল হয়।

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মাতৃভাষার মর্যাদা অনেক বেশি। পবিত্র বাইবেল এ বলা হয়েছে, ‘এই জগতে কত না কত রকমের ভাষা রয়েছে, কোনটাই তো অর্থহীন নয়।’ (১ করিন্থীয় ১৪:১০, মঙ্গল বার্তা, ৪৪৪ পৃষ্ঠা)

ভাষা কি এর উত্তরে ড. সুকুমার সেন বলেন, “ভাষার মধ্য দিয়া আদিম মানুষ সামাজিক প্রবৃত্তির প্রথম অঙ্কুর প্রকাশ পাইয়াছিল; ভাষার মধ্য দিয়াই এই সামাজিক প্রবৃত্তি বদ্ধমূল হইয়া বানরকল্প আদিম নরকে পশুত্বের পর্যায় হইতে চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহাকে মননশীল মানব করিয়াছে। ভাষা চিন্তার শুধু বাহন নয়, প্রসূতিও।

প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘মনের ভাব-প্রকাশের জন্য বাগ-যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন, কোনো বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত, শব্দ-সমষ্টিকে ভাষা বলে। ভাষা হলো শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যম, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাহন, শিল্পকর্ম ও অগ্রগতির ধারক। ভাষার ভেতরে সংরক্ষিত থাকে চিন্তাচেতনা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বহুভঙ্গিমা দৃষ্টিভঙ্গি এবং আরো কত কিছু।

আর মায়ের মুখ থেকে যে ভাষা বের হয়, বা মা যে ভাষায় তার সুখ দুঃখের হিসেব কষে, সন্তানের সুখের স্বপ্ন দেখে সেটিইতো মাতৃভাষা। মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “আর আমি সমস্ত পয়গম্বরকে তাহাদের কাওমের (স্বজাতির) ভাষায় পয়গম্বর করিয়া পাঠাইয়াছি, যেন তাহাদের নিকট (আল্লাহর বিধানসমূহ) বর্ণনা করিতে পারেন; অনন্তর আল্লাহ্ তায়ালা যাহাকে ইচ্ছা বিপথগামী করেন; এবং যাহাকে ইচ্ছা পথ দেখান; আর তিনি প্রভাবশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত : ৪, বঙ্গানুবাদ নুরানী কোরআন শরীফ, পৃ-৪০৭)।

‘সমুদ্রের মধ্যে হাজার হাজার প্রবাল আপন দেহের আবরণ মোচন করতে করতে কখন এক সময়ে দ্বীপ বানিয়ে তোলে। তেমনি বহু সংখ্যক মন আপনার অংশ দিয়ে গড়ে তুলেছে আপনার ভাষাদ্বীপ। এভাবে এক এক ভৌগলিক ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষা থেকে বিভিন্ন ভাষার উদ্ভব।

ভাষা শুধু মনের ভাবাবেগ প্রকাশ আর যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, ভাষা অর্থনৈতিক অস্থিত্বের মাধ্যমও। উৎপাদনের সাথে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে রয়েছে এর সুদূর প্রসারী প্রভাব। ‘ভাষাকে আঘাত করলে পরোক্ষভাবে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপরই আঘাত করা হয়।

বর্তমান বিশ্বে গণনাকৃত মোট ভাষার সংখ্যা ৬৯১২ টি। সিল নামক ভাষা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে এই মুহূর্তে (ফেব্রুয়ারি/২০০৮) বিলুপ্তপ্রায় ভাষার সংখ্যা ৫১৬টি। জাতিরাষ্ট্রের এ রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ প্রবণতার বিপদ হলো বিশ্বে প্রায় সাত হাজার ভাষার মধ্যে সাকুল্যে মাত্র ৩০০ ভাষা (প্রায় ২৫০টি জাতিরাষ্ট্রের বিপরীতে) রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পায়, বাকি ভাষাগুলো থাকে অবহেলিত। এই অবহেলিত ভাষা কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে চরম অবহেলা আর অনাদরে। আবার অনেক সময় এই ভাষাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার নীল নক্সা তৈরি করা হয়। প্রতিবাদ মূখর মানুষ মায়ের ভাষা রক্ষা করতে গিয়ে জীবন বাজি রাখতে কার্পণ্য করেনি, তাই বিশ্বের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন নামে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশেই মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম হয়েছে, মায়ের ভাষার মর্যাদার দাবিতে প্রাণ দিয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মাতৃভাষার আন্দোলনের দু’একটি ঘটনা উল্লেখ না করলে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যাবে। তাই মাতৃভাষার মর্যাদার স্বার্থে ভাষা আন্দোলনের দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ভারতেই অন্ধ্র প্রদেশে তেলেগু ভাষাভিত্তিক প্রদেশের দাবিতে ১৯৫২ সালে গান্ধীবাদী শ্রীরামুলু এক সংগ্রামী অনশন করে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর বিরাট প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে নেহেরু সরকার সেই দাবি মেনে নেন, এবং তেলেগুভাষীদের নিজস্ব রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীরামুলু ‘আজ অমরজীবী’ বলে সম্মানিত হন।

১৯৬০ সালের ৩ মার্চ আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা বিধানসভায় অসমিয়াকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হবে বলে জানালে প্রতিবাদের ঝড় উঠে, এবং বাংলাকে সরকারি ভাষা করার জোরদাবি উত্থাপন করে।

সংগ্রাম পরিষদের ‘পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো ১৯৬১ সালের ১৮ মে রাত ১২ টার পর থেকে প্রায় ১০ হাজার তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ শিলচর রেলস্টেশনের অহিংস অবস্থান ধর্মঘট করার জন্য সমবেত হতে থাকে’। ১৯ মে ভোর ৪ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত হরতাল ডাকা হয় বরাক উপত্যকায়। সকাল থেকে দলে দলে লোক জড়ো হয় তারাপুর রেল স্টেশনে। সবাই রেল লাইনের উপর বসে পড়ে সমস্বরে ধ্বনি তুলল, জান দেব, জবান দেব না। ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’।

শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। উত্তেজিত জনতার প্রতিরোধে সরকার বাহিনী ট্রেন চালাতে ব্যর্থ হন। ১৯ মে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পুলিশ এদের অনেককেই গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। বিভিন্ন দফায় লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস-এর সঙ্গে যোগ দেয়, এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে অনেক রেলকর্মচারীরা। বেলা আড়াইটার দিকে রেল স্টেশনে কর্তব্যরত বিএসএফের সদস্যর হঠাৎ গেরিলার ভঙ্গিতে গুলি বর্ষণ আরম্ভ করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষনাৎ শহীদ হন নয় জন। তাঁরা হলেন-সুনীল সরকার, সুকোমল পরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সুত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র পাল, কমলা ভট্টাচার্য, কানাই নিয়োগী। পরদিন স্টেশনের পুকুর থেকে সত্যেন্দ্রকুমার দেবের বুলেটবিক্ষত দেহ উদ্ধার করা হয়। রাতে হাসপাতালে মারা যান বীরেন্দ্র সূত্রধর। মোট ভাষা শহীদের সংখ্যা দাড়ায় ১১। ১৯ মে পুরো দিনটি ছিল উত্তাল ও ঘটনাবহুল। প্রশাসন কারফিউ জারি করে। গ্রেফতার করা হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে। কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত হননি আন্দোলনকারীরা। তাদের রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ওই অঞ্চলের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রশাসনিক স্বীকৃতি দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়। ১১ জন ভাষা শহীদের রক্তের বিনিময়ে অবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রদত্ত সূত্রের ওপর ভিত্তি করে গ্রহিত সংশোধনী আইনে কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়। এভাবেই আসাম রাজ্যে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষা বিধানসভায় স্বীকৃতি পায়।

এরপরও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট বাচ্চু চক্রবর্তী নামে একজন মৃত্যুবরণ করেন। ৬ অক্টোবর মারা যান মোজাম্মেল হক। ৭ অক্টোবর রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দিষ্ট হন অনিল বরা। ১৯৮৫ সালের ২৪ জুন কৃষ্ণ কান্ত বিশ্বাস ১৯ মে’র গুলির ক্ষতজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৬ সালে ২১ জুন দু’জন মারা যান-তাদের নাম বিব্যেন্দ দাস, জগন্ময় দেব। তাদের এই আত্মত্যাগ বিশ্বে তেমন পরিচিতি পায়নি, এমনটি পশ্চিম বাংলা বা বাংলাদেশের মানুষের কাছেও নয়, যা খুবই দুঃখজনক।

অপরদিকে মাতৃভাষার শিক্ষার দাবিতে ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ স্কুলশিক্ষার্থী নেমে এসেছিল জোহানেসবার্গের কাছে সয়েটো শহরের রাস্তায়। পুলিশের গুলিতে সেদিনই ঝরে পড়ে ২৩ টি কচি প্রাণ। আহত হয় দুই শতাধিক। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার ১৬ জুন দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘যুব দিবস’ ঘোষণা করে। দিনটি এখন সে দেশে রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন।

দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গরা শতাব্দীর পর শতাব্দী জীবনের ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে বঞ্চনা কমতে থাকে ১৯৫৪ সালে বান্টু এডুকেশন অ্যাক্ট প্রণয়ন ও ব্ল্যাক এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট গঠনের ফলে। এ বিভাগের কাজ ছিল ‘কৃষ্ণাঙ্গদের স্বভাব-চরিত্র ও প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে মানানসই’ একটি পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা। তখনকার নেটিভ অ্যাফেয়ারস মন্ত্রী ড. হেনড্রিক ভ্যারওয়ার্ড বলেন, ‘কালোদের ছোট বয়স থেকেই শিক্ষায় সম্পৃক্ত করা হবে; তবে ইউরোপীয়দের সমমর্যাদার শিক্ষা তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।’ কালোদের এমন শিক্ষা দেওয়া হবে না যাতে তারা সাদাদের সমান মর্যাদা অর্জন করতে পারে। সাদাদের অধীনে কায়িক শ্রম দেওয়া বা মাতৃভূমিতে নিজেদের জনগণের সেবা প্রদানই ছিল এই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। বান্টু আইনের আগে কালো শিশুরা মিশনারিদের স্কুলে পড়ত অথবা অশিক্ষিতই থেকে যেত। এ আইনের ফলে শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ বেড়ে গেল। নেটিভ অ্যাক্ট নামে অন্য একটি আইনের বলে ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন বন্ধ থাকায় কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছিল। তাই বান্টু আইনের ফলে বিদ্যালয়ে শিশুদের ভর্তির হার বাড়লেও অন্য সব কিছু রয়ে যায় আগের মতোই। সরকার ১৯৭৬ সাল থেকে মাধ্যমিক স্কুলে গণিত ও সামাজিক শিক্ষা বিষয় দুটি ‘আফ্রিকানস ভাষায় এবং সাধারণ বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক বিষয়গুলো ইংরেজিতে শিক্ষা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে। যদিও ১৯৭২ সালে এক জরিপে ৯৮ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ‘অফ্রিকানস’ ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।

ইন্দোনেশীয়, মালয়, ওলন্দাজ, জার্মান প্রভৃতি কতগুলো ভাষার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা একটি ভাষা হলো ‘আফ্রিকানস’। মূলতঃ দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন ওলন্দাজ সাদা শাসক গোষ্ঠীর ভাষা ছিল ‘অফ্রিকানস’। বর্ণবাদী সরকারের দাবি, তাদের অর্থে কালোরা তাই শিখবে যা সাদারা চাইবে। কিন্তু বাস্তবে সাদাদের জন্য শিক্ষা অবৈতনিক হলেও কালোদের গাঁটের পয়সা খরচ করেই শিক্ষা অর্জন করতে হতো।

এই সবকিছুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল মাধ্যমিক স্কুলের কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা। তারা বলল, ‘আমাদের মা-বাবা সাদা শাসনের নিগড়ে নিষ্পেষিত হওয়ার জন্য নিজেদের সমর্পণ করেছেন। যুগের পর যুগ তাঁরা এসব আইন মেনে চলেছেন এবং তা তাঁদের শরীরে সয়ে গেছে। কিন্তু আমরা এই শিক্ষা গেলানোর বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ জানাচ্ছি। যে শিক্ষা আমাদের নিজেদের মাতৃভূমিতে দাসত্বে আবদ্ধ করতে প্রণীত, আমরা তা মানি না। 

আফ্রিকানস ভাষা অধিকাংশ শিক্ষকের কাছে ছিল অপরিচিত। ফলে, শিক্ষাবর্ষের শুরুতে জানুয়ারি মাসে অভিভাবক ও স্কুলের অধ্যক্ষরা আফ্রিকানস ভাষায় শিক্ষা প্রদান ও গ্রহণ থেকে অব্যাহতি চান। পরবর্তী মাসগুলোয় এ নিয়ে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। জুন আসতে না আসতে শিশুরা প্রতিবাদমূখর হয়ে উঠে।

ব্ল্যাক কনশাস মুভমেন্টের সহায়তায় সয়েটো স্টুডেন্টস রিপ্রেজেনটেটিভ কাউন্সিল (এসএসআরসি) অ্যাকশন কমিটি ১৩ জুনের সভায় পরবর্তী ১৬ তারিখে সমবেত হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের এ পরিকল্পনা ভেস্তে যাবার আশংঙ্কায় তারা তাদের মা-বাবাকে না জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

১৬ জুন ১৯৭৬। সকাল থেকেই টিসিয়েটিস মাশি নিনিনির নেতৃত্বে অরল্যান্ডো ওয়েস্ট সেকেন্ডারি স্কুলের দিকে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের মিছিল। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কলকাকলিতে মুখরিত ভিলাকাজি স্ট্রিট। সবাই সেখান থেকে ধাবিত হচ্ছিল সয়েটোর ওরল্যান্ডো স্টেডিয়ামের উদ্দেশ্যে। বাড়তে বাড়তে তাদের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ৫, ১০, ১৫ হাজার। স্টেডিয়ামে পৌঁছে তারা একটি প্রতিবাদলিপি তৈরি করে জোহানেসবার্গের উপশহর বুয়েন্সে অবস্থিত ট্রান্সভাল ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশনে পেশ করবে।

শেতাঙ্গ পুলিশরা দেয়ালের মতো দাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের গতিরোধ করে এবং তাদের বিচ্ছিন্ন হতে বলল। শিক্ষার্থীরা আরো বেশি প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে। পুলিশ সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে করতে প্রথম দিকে কুকুর লেলিয়ে দেয়। তারপর শুরু করে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ। সমাবেশ থেকে পুলিশকে লক্ষ করে ইট-পাটকেল আর পানির বোতল ছুড়ে মারতে থাকে প্রতিবাদী শিশুরা। এক পর্যায়ে পুলিশ কোনো সতর্ক না করেই গুলি চালায় নির্বিচারে। পুলিশের গুলিতে হাস্টিং এনডলভু ও হেক্টর পিটারসন মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে এক এক করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ২৩টি কচি প্রাণ। পরদিন বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে আফ্রিকানসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, সমাবেশ আর পুলিশের নির্বিচার গুলি। সয়েটো ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে উইটয়ারসর‌্যান্ড, প্রিটোরিয়া, ডারবান ও কেপটাউনে। ‘বছরের শেষ নাগাদ নিহতের সংখ্যা পৌছাল ৫৫৭ জনে। আহত হয় তিন হাজারের বেশি।

আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে শিক্ষার্থীরা প্রায় নিজেদের পছন্দমতো ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের অধিকার পায়। সয়েটোতে গড়ে ওঠে আরও স্কুল ও একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ। শিক্ষকেরা সুযোগ পান কর্মকালীন প্রশিক্ষণ আর যোগ্যতা অর্জনের জন্য শিক্ষা ভাতার। শহরের বসবাসকারী কালোরা পায় স্থায়ী বাসিন্দার মর্যাদা। শহরে কালোদের ব্যবসা করার ওপর নিষেধাজ্ঞার আইনটিও বাতিল ঘোষিত হয়।

আজ... বিশ্বের প্রায় সাত হাজার ভাষার মধ্যে প্রতি সপ্তাহে দুটি এবং প্রতিবছর শতাধিক ভাষা অপমৃত্যুর কবলে পড়ছে। এভাবে ভাষার অপমৃত্যু ঘটতে থাকলে কালের অতল গহ্বরে একদিন দু’একটি ভাষা ছাড়া হারিয়ে যাবে সব। তাই এখনই সময় আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষাসহ সকল মাতৃভাষাকে রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার।

পরিশেষে, ভাষা আন্দোলন বলতে আমাদের যে একচ্ছত্র দাবি ছিল আজ তা আর আমাদের একার নয়। এ দাবি ও অধিকার গোটা বিশ্বের মানুষের।...আগে আমরা ধরেই নিতাম একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই বাংলা ভাষার জন্য ভালোবাসা, এখন আমরা আমাদের ভাবনাটাকে আরও একটু বড় করেছি। এখন বলছি এবং ভাবছি একুশে ফেব্রুয়ারি মানে শুধু বাংলা ভাষা নয়, যার যার মাতৃভাষার জন্য ভালবাসা। আজ একুশের বাণী দেশের গন্ডি পেড়িয়ে সারাবিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা তুলে ধরার সাথে সাথে বিশ্বের সকল মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালবাসার কথা বলছে, মর্যাদা সমুন্নত রাখার কথা বলছে। তাই আজ, একুশ শুধু বাঙালির অহংকার নয় গোটা বিশ্বের সকল ভাষাভাষির অহংকার।

লেখক: কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা।

ফেসবুকে অগ্নিগিরি

সংবাদপত্র

পত্রিকার কলামসমূহ

বাংলা সাময়িকী

রবীন্দ্র রচনাবলী

নজরুল রচনাবলী

টেলিভিশন

জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সমূহ

অনলাইন রেডিও