ঈদ : আমাদের ছেলেবেলা : আমাদের সংস্কৃতি
এম. সাইফুল আরেফীন

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাকিদ...’

ফেরদৌসি রহমানের কণ্ঠে কাজী নজরুল ইসলামের এই গান রেডিওতে বেজে ওঠার সাথে সাথেই যেন ঘোষণা হয়ে যেত এক বিরাট আনন্দ উৎসবের। পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে ধুম পড়ে যেত আয়োজনী কলরবের। জনে জনে মনে মনে শিহরণ চলতে থাকতো সেই আনন্দ বন্যার। দীর্ঘ সাওম সাধনা আর প্রতীক্ষার পর বাঁধভাঙা আনন্দের প্রধান ফটক যেন খুলে যেত ফেরদৌসির কণ্ঠ বেজে ওঠার মধ্যদিয়েই।
ত্যাগের ভেতর দিয়ে আনন্দ সংগ্রহের এমন দূর্লভ সুযোগ শুধু ঈদই এনে দেয়। ছেলেবেলায় ঈদ বলতে আমরা আনন্দের মাত্রাগত কারণে রোজার ঈদকেই বুঝতাম। কোরবানির ঈদে গরু-ছাগলের রশি টানাটানি আর গোস্ত বিলানোতে বড়দের মুন্সিয়ানাই প্রাধান্য পেত। তবে ছোট বেলাকার সেই ঈদটা যেন আজ কোথায় হারিয়ে রয়েছে। আনন্দটাও কেমন ফিকে হয়ে গেছে। সেই সাথে পাল্টেছে ঈদ যাপনের সংস্কৃতিও।

যখন ছোট ছিলাম তখন চাঁদ দেখা নিয়ে বিস্তর উত্তেজনা ছিল আমাদের মধ্যে। ২৯ বা ৩০ রোজার ইফতারের আগেই ছেলে-বুড়ো, কচি-কাঁচারা আমরা সবাই হাজির হয়ে যেতাম উঁচু রাস্তায়। সরকারি ঘোষণা যথারীতি রেডিওতে হতো, কিন্তু আঙুল উঁচিয়ে একজন আরেকজনকে চাঁদ দেখানোর যে কৃতিত্ব, বাড়ী ফিরে এসে ঈদের নিশ্চিত ঘোষণায় যে বীরত্ব- তা ছিল ঐ বয়সে খানিকটা দিগি¦জয়ের মতো। খালি চোখে চাঁদ দেখার হল্লায় আমরা থাকতাম লাফালাফির দলে। বড়রা হাত তুলে দোয়া করতেন। বয়স্ক মুরুব্বিদের কাউকে কাউকে চোখের পানি সমেত হাত তুলতে দেখেছি। হয়তো তারা ভাবতেন এই সওমে তার গুনাহ মাফ হলো কিনা, অথবা ভাবতেন আগামী সওম তার কপালে জুটবে কিনা। আমাদের ঐসব বুঝবার সময় হয়নি তখনও। গাঙের শ্যাওলার মতো আমরা শুধু দুলছি আর দুলছি, আনন্দ আর ভালোলাগার জোয়ারে।

চাঁদ দেখার সেই রেওয়াজ এখন নেই। হল্লা করে রাস্তায় বেরিয়ে আসা, চাঁদ দেখাদেখি আর উত্তেজনার কাঁপন- এর জায়গাটা দখলে নিয়েছে শপিং মলে ভিড়াভিড়ি, কেনাকাটা আর মহল্লা বা রাস্তায় বিকট জোরে হিন্দি গান বাজানো। আর মানুষদেরও কী হয়েছে জানিনা- তারা রোজা রাখা বা ঈদের দিন নির্ধারণে সরকারি ঘোষণাকেই মেনে নিয়েছে। হতভাগা এই শহুরে লোকদের মাথার ওপরে আকাশ বলে কিছু নেই, তাই চাঁদেরও হাসার সুযোগ নেই।

আমাদের জীবনেও খানিক পরিবর্তন এলো- রেডিওর জায়গা দখল নিলো সাদাকালো টেলিভিশন। ১৯৮৪ তে আমাদের জন্যে টিভি নিয়ে স্বর্গের দূতের হাসি হাসতে হাসতে বাড়ী ঢুকলেন আব্বা। আনন্দে আমরা বেহুঁশ। একমাত্র চ্যানেল বিটিভিতে তখন অনুষ্ঠান বলতে সারাদিন গান, বিজ্ঞাপন, সিনেমা আর দু’একবার খবর প্রচার। ঈদ উপলক্ষে বাংলা সিনেমার ঘোষণাই ছিল সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।

শেষ রোজায় মেন্দি পাতা বেটে হাতে লাগাতাম আমরা। সেখানেও উৎসব। নখে এবং তালুতে কার কতো লাল হয়েছে সেটা দেখাদেখি হবে কাল ঈদের দিন। হাল জামানায় বিকল্প হিসেবে ক্ষতিকর টিউব মেহেদি চলছে বেশ। চাঁদ রাতেই বাড়ীর কর্তারা নামতেন বাজার সদাইয়ে। আর সদাই এলে গভীর রাত পর্যন্ত আমরা মায়ের সাথে লেগে থাকতাম ছুলা-কোঁটাবাঁছায়। ঈদের জামা যেটা পেতাম, সেটা যার যার সাধ্যমতো লুকিয়ে রাখতাম। ঈদের আগে কাউকে জামা দেখানো যাবে না। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে লুকানো জায়গায় গিয়ে নয়া জামা স্পর্শ করে আসতাম- ওটা ঠিকঠাক আছে এবং এখনও কেউ দেখেনি- এই প্রশান্তিও আনন্দের আরেক কারণ। সম্ভবত ওটাই ছিল আমাদের জীবনের প্রথম গোপনীয়তা।

ঈদের দিন সকালেই শুরু হয়ে যেত হৈ চৈ তাড়াহুড়ো। গোসল সেরে নতুন কাপড় পরে তাড়াতাড়ি যেতে হবে ঈদগায় হেঁটে হেঁটে। মা’দের ঘুম হারাম। ভোরে উঠেই গমের আটার লুচি আর দুধ দিয়ে কাঁচা বাদামসমেত সূতাকাটা সেমাই রান্না খেয়ে আমরা রওনা হতাম। তার আগে গায়ে আতর এবং চোখে সুরমা লাগিয়ে দেয়া হতো। ঈদগায় বেরুনোর ঠিক আগ দিয়েই আব্বা-আম্মার পায় সালাম করতাম। টানাটানির সংসারে তারাও যেন বুঝতে পেরে কিছু পয়সা বা দু’এক টাকা হাতে রাখতেন। সালামি বাবদ। দশ পয়সার আইসক্রিম, হাওয়াই মিঠাই বা চার আনার কুলফি মালাই ছিল আমাদের টার্গেট।

ঈদগাহর পথে আমরা ছেলেমেয়েরা একজন আরেকজনের নতুন জামার দিকে তাকিয়ে দেখতাম। আব্বার লম্বা লম্বা পা ফেলার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে কখনও বা দৌড়াতাম। কদমের বৃক্ষ পেরিয়ে বৃদ্ধ এক বটগাছ তলায় আমাদের ঈদগায় যখন কাতার বন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে যেতাম, সফেদ-শুশ্রুবৃদ্ধ ইমাম সাহেব তখন আরবি ও বাংলায় নিয়ত বলে দিতেন। দেরী করা লোকজন দৌড়ে এসে জামাত ধরতো। আস্তে আস্তে পুরো ঈদগাহ ভরে যেত সাদা পাঞ্জাবী আর সাদা টুপীর সমুদ্রে। নানান গন্ধের আতরের ঘ্রাণ, লোবান, গোলাপজল আর কদমের গন্ধে একাকার হয়ে সাদা পোশাকের সমুদ্র কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠত। পরিবেশটা যেন পূণ্যময় আর অপার্থিব ঠেকতো। খুব দ্রুতই ঈদের নামাজ শেষ হয়ে যেত। কিন্তু খুতবা শেষে চলতো দীর্ঘ মুনাজাত। সুর করে সেই মুনাজাতের মধ্যে যখন মা-বাবার জন্য দোয়া হতো, তাদের রুহের মাগফেরাত আর ক্ষমা ভিক্ষে চাওয়া হতো, তখন অনেক যুবক-বৃদ্ধদের সাথে আব্বাকেও আমি শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি। কি জানি- হয়তো তার বাপ-মার কথা খুব মনে পড়ে যেত ঐদিন, যাদের হাত ধরে সেও সুরমা মেখে ঈদগায় আসতো, বাপের লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটার পাশে তিনিও দৌড়াতেন, অথবা ফেরার পথে কোলে চড়ে বাতাসা খেতে খেতে ফিরতেন! আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সেই কান্না দেখতাম আর হিসাব মেলাতে না পেরে অথৈ রহস্যের মধ্যে পড়ে যেতাম। খানিক ভয়ে খানিক অজানা কারণে। তবে তাদের চোখের পানিতে চোখের সুরমা যেত ধেপড়ে। কিম্ভুতকিমাকার লাগত দেখতে- তারা তা বুঝতে পারতেন না। ওদিকে লম্বা মুনাজাতে আমার হাত লেগে যেত। তবে মুনাজাত শেষেই ঈদগাহ ভাঙত না। নাতিদীর্ঘ সময় ধরে চলতো কোলাকুলি, কুশলাদি বিনিময়। কেউ কেউ বুক মেলাতে গিয়ে কাঁদত, কেউ হাসত। এখনকার মানুষেরা অনেকেই কোলাকুলির অনুষঙ্গ এড়িয়ে যান, হয়তো অর্থহীনতা বা ওজনহীনতার ভয়ে। অন্যদিকে- আমাদের নজর ছিল ঈদগাহর বাইরের কুলফিওয়ালা, মিঠাইওয়ালা, খুরমাওয়ালাদের দিকে। নিজহাতে পয়সা দিয়ে এটা ওটা কেনা ছিল আলাদা ব্যাপার। কখনও হুড়োহুড়ি ভিড়ের মধ্যেই আমি দৌড়ে বেরুতাম কুলফিওয়ালার দিকে। আমাকে দেখতে না পেয়ে আব্বা এদিক ওদিক খুঁজতেন, চেঁচিয়ে নাম ধরে ডাকতেন- আমি হয়তো তার খুব কাছেই চুপ মেরে দাঁড়িয়ে মজা দেখতাম। আহা, কী ঝলমলে আকণ্ঠ আনন্দের দিন ছিল আমাদের!

ঈদের দিন প্রায় সব বাড়ীতেই সেমাই রান্না হতো। ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে বিভিন্ন বাসায় ঘুরে বেড়াত। মা-চাচীরা দুধে ভেজানো সূতো-কাটা সেই সেমাই তাদের খেতে দিতেন। এমনটাও হয়েছে- কাদের বাড়ীতে আমরা খেয়েছি তা বাসায় গিয়ে বলতেও পারতাম না। মানুষে মানুষে সম্পর্কটা আমরা দেয়ালহীন, শর্তহীন পেয়েছি। আজকের অগ্রগামী সমাজে আমাদের অনেক অর্জনের মধ্যে অসংখ্য অদৃশ্য দেয়ালও অর্জন হয়েছে। এই দেয়াল বিশ্বাসহীনতার, এই দেয়াল অনুদারতার, ভয়ানক স্বার্থপরতার!

মানুষের মাঝে ব্যবধান কমানোর যে ঈদ, ধনবানের সম্পদে দীন-দুঃখীদের হকদার হবার যে ঐতিহাসিক ঘোষণা, ভ্রাতৃত্বের যে সীসাঢালা প্রাচীর-বন্ধন- তার সাক্ষাত অপমান চলছে, চলছে ভয়ঙ্কর প্রহসন। এখনও বৈভবশালীরা সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ায় ঈদ শপিং সারেন, অন্যদিকে আরো মানুষেরা প্রতিদিন ডাস্টবিন ঘেঁটে খাবার সংগ্রহে নামে। এখনও এদেশে যাকাত-দান-যোগ্য মানুষের সংখ্যা কতো, টাকার পরিমাণ কতো- কেউ জানে না। এখনও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েট দেয়ালে চিকা টাঙিয়ে লেখে... কেউ একটা চাকরী দেবেন, আমার ফোর ফার্স্ট ক্লাস...। এখনও সৈয়দ মুজতবা আলীর বড়োলাটের কুকুরের এক ঠ্যাঙের সমান প-িত শিক্ষকের পুরো পরিবার। আজকেও ফিলিস্তিনে অসংখ্য শিশুর লাশ বুকে করে রক্তাক্ত মা-বাবারা ফরিয়াদ জানাচ্ছে, আর মুসলিম মধ্যপ্রাচ্য নেতারা আছেন বেশী ছাওয়াবের আশায় ইফতারির কপট আয়োজনে।

আমার বিস্ময়- এই ভয়ঙ্কর অসারতা, এই দুর্বৃত্ততা কীভাবে মেনে নিচ্ছে শিক্ষিত যুবকেরা! কীভাবে প্যাঁচার মতো চোখ বন্ধ করে সূর্যোদয় অস্বীকার করছে সভ্য মানুষেরা! তবে কি তারা আর মানুষ নেই! মানুষ কোথায়?

আমরা আজ অন্তহীন উপেক্ষায় পড়ে গেছি। হিটলার নয়- সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর জন্য অনিঃশেষ প্রতীক্ষা। আরশের মালিকের কাছে তাই জেনে নিতে চাই- আমাদের অক্ষমতা নির্বীর্যতা, হে রব, কিসের বিনিময়ে প্রায়শ্চিত্ত হবে? সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর গর্ভধারিণীর কাছে মিনতি- তিনি কি আরো একবার প্রসব বেদনা সহ্য করতে পারেন? আর মুসলিম বিশ্ব নেতাদের মাসালা জানিয়ে দেই- ফিলিস্তিনি শিশুদের তরল রক্তে আর নরম দেহের পোড়া গোস্তে ইফতারির মাঝে কোনো ছাওয়াব নেই।

এইসব কিছু ভাঁড়িয়ে নতুন কোনো এক দিনে হয়তো শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ প্রকাশ পাবে পশ্চিমাকাশে। মিটিমিটি সরু সেই চাঁদের পানে চেয়ে গাজার কোনো এক কিশোরীর মা মুছে ফেলবেন চোখের জল, সেই সাথে মুছে যাবে আধো আধো কথা বলা তার বুলেটবিদ্ধ শিশুটির নরম রক্তাক্ত দেহের স্মৃতি। শাওয়ালের ক্ষীণ চাঁদ আরো পষ্ট হবে, পষ্ট হবে বিশ্ব মানবতা, গুলি খাওয়া কুকুরের শেষ চিৎকারের মতোই হাওয়াই মিলিয়ে যাবে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ, ইসরাইলী তা-ব, আর খৎনাধারী নপুংসক চৌপেয়েরা, প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাবে শান্তি!

রঙিন এলসিডির বিশাল পর্দায় ফেরদৌসি রহমান আবার গেয়ে উঠবেন-
‘তোর সোনা-দানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত মুর্দ্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ্
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ...’

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

ফেসবুকে অগ্নিগিরি

সংবাদপত্র

পত্রিকার কলামসমূহ

বাংলা সাময়িকী

রবীন্দ্র রচনাবলী

নজরুল রচনাবলী

টেলিভিশন

জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সমূহ

অনলাইন রেডিও